ঢাকা, ২৩ মার্চ – করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবারও বাড়ছে। টানা ২২ দিন ধরে সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে। এতে জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে। মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মানায় সংক্রমণ আবারও বাড়ছে বলে মনে করছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
গত এক সপ্তাহে কয়েকটি অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মাস্ক ব্যবহারসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বারবার আহ্বান জানানোর পরও মানুষ তা না মানায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। গত কয়েক দিনে কয়েকশ’ মানুষকে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু তারপরও সচেতনতা বাড়েনি। অধিকাংশ মানুষকে মাস্ক ছাড়াই চলাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে।
গত চব্বিশ ঘণ্টায় দুই হাজার ৮০৯ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। দৈনিক শনাক্ত রোগীর এই সংখ্যা গত সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। সর্বশেষ গত বছরের ২০ আগস্ট এর চেয়ে বেশি রোগী (২৮৬৮ জন) শনাক্ত হয়। একই সঙ্গে গত চব্বিশ ঘণ্টায় প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আরও ৩০ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। এর চেয়ে বেশি মৃত্যুর খবর এসেছিল তিন মাস আগে। গত ৭ জানুয়ারি ৩১ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
টানা দুই মাসেরও বেশি সময় নিম্নমুখী সংক্রমণের পর চলতি মাসের শুরু থেকেই আবারও বাড়তে শুরু করে। আক্রান্ত ও মৃত্যু বৃদ্ধির এ ঘটনাকে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ বলে মনে করছেন অনেকে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। তাদের অভিমত, করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকতে মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে হাত না ধুয়ে অথবা স্যানিটাইজ না করে মুখ, চোখ ও নাক স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে সামাজিক দূরত্ব। তাহলেই এই ভাইরাস অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু: দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে কিনা জানতে চাইলে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী এটি বলা যায়। কারণ শনাক্তের হার ১৪ দিন ধরে ৫ শতাংশের ওপরে রয়েছে এবং ধারাবাহিকভাবে এটি বাড়ছে। দুই শতাংশের কাছাকাছি নেমে যাওয়ার পর শনাক্তের হার মার্চের শুরু থেকে আবারও বাড়তে থাকে। সার্বিক বিষয় বিশ্নেষণ করলে সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বমুখী ধারাকে দ্বিতীয় ধাপের সংক্রমণ বলা যায়।
করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ধাপের সংক্রমণ শুরু হয়েছে কিনা তা বুঝতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কিছু দিকনির্দেশনা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সংক্রমণের সর্বশেষ নিম্নমুখী সংক্রমণ থেকে টানা তিন সপ্তাহ পর্যন্ত আক্রান্ত রোগী ও উপসর্গ রয়েছে এমন সন্দেহভাজন যদি নূ্যনতম ৫০ শতাংশ বাড়ে এবং অন্তত ৮০ শতাংশ সংক্রমণ একটি নির্দিষ্ট ক্লাস্টারে হয়। নির্দিষ্ট ক্লাস্টার হলো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কাছাকাছি থাকা অনেকের মধ্যে সংক্রমণ। অন্তত দুই সপ্তাহ ধরে নমুনা পরীক্ষার হার ৫ শতাংশের ওপরে এবং এবং তিন সপ্তাহ ধরে মৃত্যু ও সন্দেহভাজন মৃত্যু বাড়তে থাকলে মহামারি শুরু হয়েছে বলে ধরা যাবে।
২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের উহানে প্রথম নভেল করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম তিনজনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। ১০ দিনের মাথায় ১৮ মার্চ একজন মারা যায়। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ওই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপরে ছিল।
এরপর ধীরে ধীরে তা কমতে থাকে। দুই মাস নিম্নমুখী থাকার পর নভেম্বরের শুরুর দিকে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। ডিসেম্বর থেকে আবার কমতে থাকে। ১৮ জানুয়ারির পর থেকে সংক্রমণ প্রতিদিনই ৫ শতাংশের নিচে ছিল। ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে শনাক্তের হার ২ শতাংশের কাছাকাছি নেমে যায়। ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকে সংক্রমণ আবারও বাড়তে থাকে। মার্চের শুরু থেকে ধীরে ধীরে সংক্রমণ বেড়ে গত ৯ মার্চ তা ৫ দশমিক ১৩ শতাংশে পৌঁছায়। এরপর প্রতিদিনই সংক্রমণ বাড়ছে।
গত ১৮ মার্চ শনাক্তের হার ১০ দশমিক ৪৫ শতাংশে পৌঁছায়। একই দিন ২ হাজার ১৮৭ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়। ১০০ দিনের মধ্যে এক দিনে এটিই ছিল সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের ঘটনা। এর আগে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর ২ হাজার ২০২ জন কভিড রোগী শনাক্ত হয়। এরপর প্রতিদিনই শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দুই হাজারের ওপরে থাকছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৯১ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেড়েছে। আর মৃত্যু বেড়েছে ৮৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এর আগের সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার বৃদ্ধি ছিল ৬৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। আর মৃত্যু বেড়েছিল ৪৯ দশমিক ০২ শতাংশ। সারাদেশের অর্ধেকের বেশি কভিড রোগী রাজধানীর বাসিন্দা।
সর্বোচ্চ সতর্কতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের: করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সর্বোচ্চ সতর্কতার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, নতুন করে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়টি উদ্বেগের। ২ শতাংশের কাছাকাছি নেমে যাওয়া শনাক্তের হার আবার ১১ শতাংশের ওপরে উঠে এসেছে।
তিনি বলেন, সংক্রমণ কমে আসার পাশাপাশি টিকাদানের পর মানুষ সাহসী হয়ে উঠেছিল। অনেকে মাস্ক পরা ছেড়ে দিয়েছিল। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার কারণেই সংক্রমণ আবারও বাড়তে শুরু করেছে। সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরতে হলে সঠিকভাবে মাস্ক পরা এবং বারবার হাত ধোয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় সংক্রমণ শুরু হয়েছে। প্রথম দফার তুলনায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার সংক্রমণ আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশেও দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ শুরুর ইঙ্গিত মিলেছে। নতুন করে তরুণরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং সবাইকে সতর্ক হতে হবে।
তিনি বলেন, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ও মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, টিকা শতভাগ সুরক্ষা দেবে না। টিকা নেওয়ার পরও অনেকে আক্রান্ত হয়েছে। সুতরাং টিকা নেওয়ার পরও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। সবার প্রতি আহ্বান থাকবে মাস্ক ব্যবহার করুন, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। নিজেকে ও অন্যকে সুরক্ষিত রাখুন।
সাবধান না হলে সামনে বিপদ -স্বাস্থ্যমন্ত্রী: স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, জনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য প্রধানমন্ত্রী বারবার আহ্বান জানিয়েছেন। মন্ত্রী হিসেবে তিনিও বারবার একই আহ্বান জানিয়েছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু করোনার সংক্রমণ কিছুটা কমে আসা এবং টিকাদান কার্যক্রম শুরু করার পর মানুষ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করছিল না। এরপর স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। মাস্ক ছাড়া ঘোরাঘুরি করলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দণ্ড প্রদান করা হচ্ছে। সুতরাং সবার সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।