দেশের বিল এলাকা, দুর্গম পাহাড় এবং বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল- সব জায়গায় পৌঁছে গেছে বিদ্যুতের আলো। গ্রিড সুবিধা না থাকায় এসব এলাকায় কোথাও নদীর তলদেশ দিয়ে আবার কোথাও সাগরের তলদেশ দিয়ে টানা হয়েছে সাবমেরিন ক্যাবল। যেখানে এটি করা যায়নি সেখানে বসানো হয়েছে সৌরবিদ্যুৎ (সোলার হোম সিস্টেম)। আর এভাবেই দেশের প্রতিটি জনপদে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুতের সুবিধা। শতভাগ বিদ্যুতায়নে আলোকিত এখন দেশের সব প্রান্ত। বেশ কিছুদিন আগেও যেখানে সূর্য ডুবে যাওয়ার পর কুপি ও হারিকেনের আলোই ছিল একমাত্র ভরসা। সেখানে এখন বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকিত হচ্ছে গোটা জনপদ। এসব জায়গায় একসময় কৃষিকাজ করে এবং মাছ ধরেই যেখানে মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতেন, এখন বিদ্যুতের সুবিধাভোগী হওয়ায় মানুষজন ছোট আকারে ধানকল থেকে শুরু করে হাস-মুরগির খামার, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানা, তাঁতশিল্প এবং যন্ত্রচালিত বিদ্যুতের ব্যবহার করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
জানা যায়, দুর্গম চরে আলো পৌঁছে দিতে সরকার দেশের ৫০টি এলাকায় ৫৩ কিমি সাবমেরিন ক্যাবল নির্মাণ করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। অফগ্রিড এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহে ৩১৭ কোটি টাকার বড় প্রকল্পের বেশির ভাগই ব্যয় হয় সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনে।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, চরাঞ্চলে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে যাওয়ায় সেখানকার জীবনব্যবস্থা রীতিমতো বদলে গেছে। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীদের সঙ্গে চরাঞ্চলের মানুষরাও বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেওয়ার এই উৎসবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা এরই মধ্যে দেশের সব অফগ্রিড এলাকায় সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। আর যেসব এলাকায় সাবমেরিন ক্যাবল নেওয়া যায়নি সেখানে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে।
ভোলা সদর থেকে ১২০ কিমি দূরে চর কুকরিমুকরি। নদীর তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে এই জনপদকে যুক্ত করা হয়। সরেজমিন চর কুকরিমুকরিতে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যুতের আলো পৌঁছে যাওয়ায় এখন রাত পর্যন্ত সরগরম থাকছে এখানকার হাটবাজার। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তারা এখন শহরের মতোই সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারছেন। ঘরে টিভি দেখতে পারছেন। মোবাইলে চার্জ দিতে পারছেন। ভোলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সূত্রে জানা যায়, ৩৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে কুকরিমুকরিসহ আশপাশের ১৬টি চরে ১ হাজার ৪২৮ কিমি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে। এসব চরের ৭১টি গ্রামে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ৩৬ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎ সুবিধা লাভ করবেন।
পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে চরাঞ্চলেও বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়েছেন চরের ৫৭টি গ্রামের মানুষ। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চরআত্রা, নওপাড়া, জাজিরার কুন্ডেরচর, ভেদরগঞ্জের কাঁচিকাটা, চাঁদপুর সদরের রাজরাজেশ্বর, মতলবের একলাশপুর ও জাহিরাবাদ ইউনিয়ন পদ্মা নদীর চরে অবস্থিত। পদ্মা নদীর তলদেশ দিয়ে দেড় কিমি সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে প্রথমে বিদ্যুৎ নেওয়া হয় নড়িয়ার নওপাড়া ও চরআত্রা ইউনিয়নে। নওপাড়ায় ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ওই উপকেন্দ্র থেকে ৫৭টি গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। গ্রামগুলোতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে চরাঞ্চলে ২৭৮ কিমি সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে। আর নড়িয়ার নওপাড়া ও মুন্সীগঞ্জের দীঘিরপাড় এলাকার পদ্মা নদীর ওপরে আটটি খুঁটির মাধ্যমে দেড় কিমি সঞ্চালন লাইন দিয়ে চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ আনা হয়েছে। বর্তমানে চরের সাড়ে ১২ হাজার গ্রাহকের ১ দশমিক ৫২ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা আছে।
কুড়িগ্রামের ৫৭টি দুর্গম চরে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। সেখানে নদনদীর তলদেশ দিয়ে ২১টি পয়েন্টে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ৫০টি চরে ৪৫০ কিমি বিদ্যুতের লাইন স্থাপন করা হয়েছে। বিদ্যুৎ আসায় এসব চরাঞ্চলে এখন টেলিভিশনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সামগ্রী ব্যবহারে এসব চরের মানুষের জীবন আরও সহজ হয়ে উঠেছে। ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিনের পরিবর্তে এখন বৈদ্যুতিক সেচ দিয়ে চাষাবাদ করছেন এসব চরের মানুষ। আর যেসব এলাকায় বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন করা সম্ভব হয়নি সেখানে সৌর প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পটুয়াখালী সদর উপজেলা থেকে ৪০ কিমি দূরে অবস্থিত বিচ্ছিন্ন উপজেলা রাঙ্গাবালীতেও সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ভোলা থেকে নদীর তলদেশ দিয়ে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে রাঙ্গাবালীর ছোট বাইশদিয়া ইউনিয়নের গহিনখালীতে ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। গলাচিপা নদী ও বুড়াগৌরাঙ্গ নদের দুটি শাখার ৫ দশমিক ৩৮ কিমি তলদেশ দিয়ে ১১ কেভি সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে এই উপজেলায় বিদ্যুৎ পৌঁছানো হয়।
পর্যটকপ্রিয় হাতিয়া দ্বীপ, নিঝুমদ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপেও শতভাগ বিদ্যুতায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এরই মধ্যে বিদ্যুতের আওতায় এসেছে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার নিঝুমদ্বীপ। চলতি বছরের মে মাসে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে দুর্গম এই দ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। হাতিয়ায় স্থাপিত একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে এ দ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য হাতিয়া থেকে সাগরের তলদেশ দিয়ে প্রায় দেড় কিমি ১১ কেভি সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দ্বীপে বসবাসরত অন্তত ৫ হাজার পরিবার বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। একইভাবে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে দ্বীপটির দেড় হাজার মানুষ পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে শুরু করেছেন।