দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে সরকারের দৈনন্দিন কাজ ছাড়া নীতিনির্ধারণী সব কার্যক্রম বন্ধ আছে। মন্ত্রিসভা বহাল থাকা অবস্থায় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা ভোটের প্রচারে ব্যস্ত। ফলে এই সময়ে কর্মকর্তাদের দায়িত্ব বেশি। কিন্তু বাস্তবে সরকারি কর্মকর্তারা এই সময়ে দল বেঁধে বিদেশ সফর করছেন। নথিপত্র থেকে জানা যায়, শুধু স্থানীয় সরকার বিভাগেরই ৭০-৭৫ জন কর্মকর্তা সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। আরও কয়েকজন কর্মকর্তার বিদেশ সফরের বিষয়ে অফিস আদেশ জারি হয়েছে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও সামগ্রী জাহাজীকরণ পর্যবেক্ষণের নামে এসব ভ্রমণ বা সফর সেরেছেন কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবশ্য দাবি করছে, এসব ভ্রমণ স্বাভাবিক কাজের অংশ।
জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভ্রমণ ও বদলি খাতে স্থানীয় সরকার বিভাগ ৩৬ কোটি ৮৫ লাখ ৮৮ হাজার টাকা খরচ করেছে। চলতি অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ আরও বেশি। এবার এই খাতে ৪৪ কোটি ২৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী আজকের পত্রিকাকে বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে ভ্রমণ বা প্রশিক্ষণ চলছে, বিষয়টি এমন নয়। মন্ত্রণালয় বা সংস্থাগুলো থেকে যেসব বিদেশ ভ্রমণ হয়েছে বা হবে, তা পূর্বনির্ধারিত। এখানে তাড়াহুড়া করে কোনো প্রশিক্ষণ আয়োজন করার মতো ঘটনা নেই।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, তফসিল ঘোষণার আগে ও পরে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও এর অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০-৭৫ জন কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের জন্য অফিস আদেশ জারি হয়েছে। নথিপত্রে দেখা যায়, নিরাপদ সড়ক বিষয়ে একটি প্রশিক্ষণের কাজে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার জন্য ১৩ দিনের ছুটি মঞ্জুর করা হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শাহিন উল ইসলাম এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) নির্বাহী প্রকৌশলী নায়িম রায়হান খানের। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ এলাকা পুনর্বাসন প্রকল্পের পরিচালক রফিকুল হাসান, উপপ্রকল্প পরিচালক হুমায়ূন কবির, পাবনা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অতুল মণ্ডল, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রধান প্রকৌশলী মো. মূসা ও সহকারী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান আগামী ১০ থেকে ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত জাপানে একটি কারখানা পরিদর্শনে যাচ্ছেন। সম্প্রতি কারখানা পরিদর্শনের জন্য স্পেন ঘুরে এসেছেন ঢাকা ওয়াসার তিন প্রকৌশলী। একই প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শারমীন হক আমীরের নেতৃত্বে আরও তিন প্রকৌশলী সাত দিন যুক্তরাজ্যে ছিলেন। ১০ থেকে ১৬ ডিসেম্বর চার প্রকৌশলী তুরস্ক ঘুরে এসেছেন। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের চার প্রকৌশলী, এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও এক সার্ভেয়ার ২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়া সফর করেন। এ মাসেই চীন ভ্রমণ করে এসেছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব ফজলে আজীমের নেতৃত্বে তিন কর্মকর্তা এবং এক উপসচিবের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন ঢাকা ওয়াসার চার কর্মকর্তা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সচিব আকরামুজ্জামান ও নির্বাহী প্রকৌশলী মিঠুন চন্দ্র শীল ১১ দিনের জন্য জাপান যাচ্ছেন। এমন আরও কয়েকজন কর্মকর্তার নামে বিদেশ ভ্রমণের অফিস আদেশ অনুমোদন করা আছে। এসব কর্মকর্তা জানুয়ারি থেকে দফায় দফায় বিদেশ ভ্রমণ করবেন বলে স্থানীয় সরকার বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান।
স্থপতি ইকবাল হাবিব মনে করেন, এমন সময়ে এ ধরনের বিদেশ সফর দায়িত্বহীনতার শামিল। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সেই সময়ে কর্মকর্তাদের দায়িত্ব মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলো কর্মতৎপর রাখা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, কর্মকর্তারা এ সুযোগে দল বেঁধে বিভিন্ন অজুহাতে বিদেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ছেন। এটি একদিকে যেমন দায়িত্বহীনতা, অন্যদিকে চরম মূল্যবোধের অভাব। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের এ ধরনের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।