পেশি গঠন, হাড় সুস্থ রাখা ও বিপাক ক্রিয়ায় সহযোগিতা করা এবং রক্তে শর্করার ভারসাম্য ও মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাসহ প্রোটিন শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। তবে দারিদ্র্য ও অসচেতনতার কারণে অনেকেই পর্যাপ্ত প্রোটিন গ্রহণ করেন না। বিশেষ করে দরিদ্র লোকজন সবসময় মাছ-মাংস খেতে পারেন না বলে প্রোটিনের মারাত্মক অভাবে ভোগেন। এর সমাধান দিতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন নতুন দুটি ধানের জাত। এর ভাত হবে উচ্চ মাত্রার প্রোটিনসমৃদ্ধ। ফলে তিন বেলা ভাত খেলেই শরীরে প্রোটিনের তিন-চতুর্থাংশ চাহিদা পূরণ হবে। শুধু তাই নয়, প্রায় ৩০ বছর পর ব্রি-২৮ ধানের ভালো বিকল্প হতে যাচ্ছে ধান দুটি, যাদের ফলন বেশি এবং ভাতও হয় ঝরঝরে ও চিকন।
ব্রির সূত্র জানিয়েছে, বিশেষ করে উদ্ভাবনের তিন দশক পূর্ণ হতে যাওয়ায় ব্রি-২৮ চিটা পড়াসহ রোগবালাইয়ের শিকার হচ্ছে। হারিয়ে ফেলছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। এতে জনপ্রিয় ধানটি চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষিরা। ফলে অনেক
দিন ধরেই ব্রি-২৮ এর বিকল্প খুঁজছিলেন ব্রির বিজ্ঞানীরা।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি নতুন জাত দুটি উদ্ভাবন করেন। এগুলো হচ্ছে- ব্রি-১০৭ ও ব্রি-১০৮। বিজ্ঞানীদের মতে, দুটি ধানেরই দুটি অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলো উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ও উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ। তাদের মতে, এ ধান থেকে উৎপাদিত চাল চিকন ও ঝরঝরে হওয়ায় তা বিশেষ বাজার তৈরি করতেও সক্ষম হবে। এ দুটি নতুন জাতের ধানের জাত নিয়ে এখন আশা জেগেছে সবার মধ্যেই।
ব্রির সূত্র জানায়, জাত উদ্ভাবনের পর জাতীয় বীজ বোর্ডের ১১১তম সভায় ধানের জাতগুলো অবমুক্ত করা হয়। এর ফলে ব্রি উদ্ভাবিত সর্বমোট ধানের জাতের সংখ্যা দাঁড়াল ১১৫টি। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই এই নতুন দুটি জাত কৃষকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে বলে আশা করছে বিজ্ঞানীরা।
সূত্রমতে, ব্রির নতুন উদ্ভাবিত জাত ব্রি-১০৭ প্রিমিয়াম কোয়ালিটিসম্পন্ন উফশী বালাম জাতের বোরো ধান। এ জাতটি উদ্ভাবন করতে বিজ্ঞানীদের লেগেছে সাত বছর। ২০১৫ সালে এই জাত উদ্ভাবন নিয়ে কাজ শুরু করেন ব্রির বিজ্ঞানীরা। বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে সফলতার পর সারাদেশে চাষের জন্য একটি প্রিমিয়াম কোয়ালিটির উচ্চ ফলনশীল বালাম জাতের বোরো ধান হিসেবে লতা বালামকে ব্রি-১০৭ হিসেবে অনুমোদন দেয় জাতীয় বীজ বোর্ড।
এই ধানের গড় জীবনকাল ১৪৩ দিন। এর দানার রং খড়ের মতো এবং চাল বাসমতি ও বালাম চালের মতো লম্বা ও চিকন। পূর্ণবয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ১০৩ সেন্টিমিটার। মাঠে চাষ করলে ধানের গড় ফলন হবে হেক্টরপ্রতি ৮ দশমিক ২ টন। তবে পরিচর্যা করলে ধানের সর্বোচ্চ ফলন হবে ৯-১০ টন। এ প্রজাতির ধানটি লবণাক্ত ও খরা এলাকা বাদে সারাদেশে চাষাবাদযোগ্য।
এ ধানের গুণগতমানও ভালো। অর্থাৎ চালের আকৃতি অতি লম্বা ও চিকন (৭.৬ মি.মি.)। এ ধানের চালে অ্যামাইলোজ এবং প্রোটিনের পরিমাণ যথাক্রমে ২৯.১ ও ১০.০২ শতাংশ এবং ভাত ঝরঝরে। ব্রি-১০৭-এর ১০০০টি পুষ্ট ধানের ওজন ২৬.১ গ্রাম।
এছাড়া ব্রি-১০৮ জাতটি বোরো মৌসুমে সারাদেশে চাষাবাদযোগ্য। এটি গ্রেইন টাইপ জিরা ধানের মতো। এ প্রজাতির ধানের চাল অপেক্ষাকৃত ছোট। আবার চিকনও। ফলন হেক্টরপ্রতি আট টন। তবে উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে হেক্টর প্রতি ফলন হবে ১০ টন পর্যন্ত। চালটির আকার জিরার মতো, ভাত হবে ঝরঝরে। এতে প্রোটিনের মাত্রা ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। এ ধানের জীবনকাল ১৪৯-১৫১ দিন।
বিজ্ঞানীরা জানান, কোনো ধানে যখন প্রোটিনের পরিমাণ শতাংশের কাছাকাছি হয়, তখন একে উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ ধান হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশের উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ ধান উৎপাদন করা হয় ১৯৯৭ সালে যার নাম ছিল ব্রিধান ৩৪। এর পর আরও বেশকিছু প্রোটিনসম্পন্ন ধানের জাত উদ্ভাবিত হয়।
বিজ্ঞানীরা বলেন, পুরাতন জাতকে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে নতুন জাত তৈরি হচ্ছে দেশের মানুষের চাহিদার কথা ভেবেই। ১৯৯৪ সালে উদ্ভাবিত ব্রিধান-২৮ কে আমাদের দেশে এখনো মেগা ভ্যারাইটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দীর্ঘ গবেষণার পর নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করা হলেও ২৮ জাতের ধানের জাতের বিকল্প পাওয়া যাচ্ছিল না। নতুন এ দুটি জাতে ২৮-এর চেয়ে ফলন বেশি হওয়ায় এখন বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবির নতুন দুটি জাত নিয়ে বলেন, আমাদের দেশে এখনো অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। তারা অনেক সময় মাছ-মাংসের মাধ্যমে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। তারা তিন বেলায় ভাত খায়। যেহেতু নতুন এ দুটি জাতের উচ্চ মাত্রার প্রোটিন আছে, তাই শুধু ভাতের মাধ্যমেই একজন মানুষ তার শরীরের ৭০-৭৫ শতাংশ প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে পারবে। এছাড়াও ফলন ভালো হওয়ায় কৃষক লাভবান হবেন, সঙ্গে রপ্তানিতেও ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। মূল কথা হলো, এ দুটি জাত থেকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিরাপত্তা জড়িত থাকায় ভালো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।