রোজা ঘিরে খেজুর আমদানিতে ১০ শতাংশ শুল্ক কমিয়েছে সরকার। ফলে আমদানি বাড়ায় আড়ত পর্যায়ে সব ধরনের খেজুরের মজুত বেড়েছে। খুচরা বাজারেও বেড়েছে সরবরাহ। কিন্তু কমেনি দাম। পাইকারিতে কারসাজি করে গত বছরের তুলনায় প্যাকেটপ্রতি (৫ কেজি) ১-৩ হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে। এতে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খেজুর ৪০-৫০ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে এবার রোজায় নিম্ন আয়ের মানুষের খেজুর কেনা যেন বড় দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুক্রবার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
রোজা সামনে রেখে ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ভোজ্যতেল, চিনি, খেজুর ও চালের ওপর শুল্ক কমানোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ৮ ফেব্রুয়ারি পাঁচটি আলাদা প্রজ্ঞাপনে এসব পণ্যের শুল্ক বিভিন্ন পর্যায়ে কমানোর ঘোষণা দেয়। ওই প্রজ্ঞাপনে খেজুরের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। আর আমদানিকারকরা ৩০ মার্চ পর্যন্ত এ সুবিধা পাবেন।
শুক্রবার রাজধানীর পাইকারি ফলের বাজার বাদামতলীতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খেজুরের আড়তে পাঁচ কেজি প্যাকেটের মরিয়ম প্রিমিয়াম খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা, যা গত বছর একই সময়ে বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। মাবরুর খেজুর প্রতি প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার টাকা, যা আগে ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকা ছিল। বড় আকারের ম্যাডজুল খেজুরের পাঁচ কেজির প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৭ হাজার ৫০০ টাকা, যা আগে ৬ হাজার টাকা ছিল। ছয় কেজি ওজনের আজোয়া খেজুরের প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৭ হাজার টাকা, যা গত বছর একই সময় ৬ হাজার ২০০ টাকা ছিল। দাবাস ক্রাউন খেজুরের পাঁচ কেজির প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৫০০ টাকা, যা গত বছর একই সময় ৩ হাজার ৪০০ টাকা ছিল।
রাজধানীর সর্ববৃহৎ ফলের পাইকারি আড়তের একাধিক বিক্রেতা যুগান্তরকে অভিযোগ করে বলেন, বাজারে এবার চাহিদার তুলনায় খেজুরের মজুত পর্যাপ্ত। রোজা ঘিরে খেজুরের চাহিদাকে পুঁজি করে এক শ্রেণির আমদানিকারক, কমিশন এজেন্টরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের যুক্তি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, এলসি খোলার জটিলতা এবং পরিবহণ ব্যয় গত বছরের তুলনায় বেশি। কিন্তু অনেক আমদানিকারক শুল্ক ফাঁকি দিতে উচ্চমূল্যের খেজুর কম দাম দেখিয়ে আমদানি করেছে। কিন্তু বাজারে বিক্রি করছে চার থেকে পাঁচগুণ দামে। তারা জানান, দেশে হাতেগোনা ৪০০ জন আমদানিকারক ফল আমদানি করেন। এর মধ্যে খেজুর আনেন ১০০ জন। আর এ গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর হাতে ক্রেতারা জিম্মি।
রাজধানীর একাধিক বাজারে গিয়ে খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হয় গলা বা বাংলা খেজুর। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। যা গত বছরের রমজানে ১২০-১৩০ টাকা ছিল। জাহিদি খেজুর প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৪০-২৫০ টাকা, আগে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বাজারে প্রতি কেজি দাবাস খেজুর মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৪৫০-৫৫০ টাকা। যা আগে ৩০০-৩৪০ টাকা ছিল। সে হিসাবে গলা, জাহিদি ও দাবাস তিন খেজুরের দাম প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়া প্রতি কেজি বরই খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৪৪০-৫৪০ টাকায়। গত বছর বিক্রি হয়েছিল ২২০-৪৩০ টাকায়। সে হিসাবে খেজুরের এ জাতটির দামও বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ।
বিক্রেতারা জানান, জাম্বো মেডজুল মানভেদে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকায়। গত বছর রোজায় বিক্রি হয়েছে ১১০০ থেকে ১২০০ টাকায়। সাধারণ মেডজুল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০০ থেকে ১২০০ টাকায়। গত বছর এর দাম উঠেছিল এক হাজার টাকা। মাবরুম খেজুর প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০০ থেকে ১৫০০ টাকায়। গত বছর ছিল ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা। প্রতি কেজি আজওয়া বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১২০০ টাকা। যা গত বছর ৮০০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি তিউনিশিয়া খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়। যা আগে ৩০০ টাকা ছিল।
কাওরান বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছরের রমজানের পরই ধীরে ধীরে দাম বাড়তে থাকে। ২ বছরের ব্যবধানে কিছু কিছু খেজুরের দাম এখন দ্বিগুণেরও বেশি। প্রতি মাসেই কিছুটা দাম বাড়ছে। আমদানিকারক বা পাইকারি ব্যবসায়ীরা অনেক বেশি দাম বাড়িয়েছেন।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, রোজার আগে সরকার খেজুরের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমালেও তা যথেষ্ট নয়। রমজানে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টন খেজুরের চাহিদা রয়েছে। অতীতে যে শুল্ক ধরা হতো, তা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ থাকলেও বর্তমানে যে শুল্ক, তা বাজারমূল্য থেকে অনেক বেশি। তাই চাহিদা অনুযায়ী আমদানি করা হয়নি।
তিনি জানান, খেজুর আমদানিতে পিপি ব্যাগে আগের শুল্কায়ন মূল্য ছিল কেজিপ্রতি ৫.৪৫ টাকা, আর বর্তমানে করা হয়েছে ৬৫ টাকা। ড্রাই কনটেইনারে ছিল ১০.৯৩ টাকা, যা বর্তমানে ধরা হয়েছে ১৬৪ টাকা। এ ছাড়া হিমায়িত কনটেইনারে ছিল কেজিপ্রতি ১০ টাকা, যা এখন ২৬২ টাকা। রিটেইল প্যাকেটজাত কার্টন ছিল ২১.৮৪ টাকা, যা বর্তমানে ১৮০ টাকা। তাই শুল্ক আরও না কমালে খেজুরের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে নিম্ন আয়ের মানুষের কেনা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে। আর খেজুরে যেভাবে ডিউটি কমানোর কথা, সেভাবে তো কমেনি, বরং আমদানির চেয়ে ৩ গুণ শুল্ক ধরা হয়েছে।