রাজশাহীর দুর্গাপুরের কৃষক জাহঙ্গীর আলম চলতি বছর ১০ কাঠা জমিতে বেগুন চাষ করেছেন। গত শীত থেকেই তার ওই জমি থেকে এক-দুইদিন পর পর তিন-চার মণ করে বেগুন সংগ্রহ করতে পারতেন। গত ১০ দিন ধরে ওই জমি থেকে এক কেজি বেগুনও আর সংগ্রহ করতে পারেননি তিনি। এমনকি যে গাছগুলো থেকে আরও অন্তত ৩ মাস বেগুন পেতেন সমান হারে। সেটিও আর কখনো হবে না। প্রকল রোদ আর তীব্র দাবদাহের প্রভাবে মরে যাচ্ছে বেগুন গাছগুলো। পাতাগুলো হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। এখনো গাছে ঝুলছে রোদে হলুদ হয়ে যাওয়া বেগুনগুলো। কিছু বেগুন রোগে পুড়ে কালো হয়ে শুকিয়ে গেছে। এতে যেনমাথায় হাত পড়েছে জাহাঙ্গীরের।
তিনি বলেন, ‘এখন যে বেগুনের দাম, আমি এক মাসেই অন্তত ৫০ হাজার টাকার বেগুন বিক্রি করতে পারতুক। কিন্তু এক টাকারও আর বেগুন এই জমি থেকে উঠানো যাবে না। পানির ওভাবে আর তীব্র রোদে মরে যাচ্ছে গাছ। পানি যে দিব, জমিতে তার কোনো ব্যবস্থা নাই। আবার যারা পানি দিতে পারছে, তাদের জমিতেও গরম উঠে গাছ মরে যাচ্ছে।’
সরেজমিন রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাজশাহীতে বিরাজ করা তীব্র দাবদাহ আর প্রখর রোদে আমসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে বেগুন, পটল, মরিচ, ভুট্টা, লাউসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে কৃষি বিভাগ বলছে তাদের কাছে এই ধরনের কোনো তথ্য নাই। ফসলের কিছু ক্ষতি হলেও সেটি বড় আকারে হয়েছে কিনা তা তারা জানে না।
রাজশাহীর দুর্গাপুরের আমগাছী গ্রামের কৃষক আলতাফ হোসেন জানান. তিনি প্রায় দেড় বিঘা জমিতে শসা চাষ করেছেন। গত ১৫ দিন আগেও ওই জমি থেকে এক-দুইদিন পর ৮-১০ মণ করে শসা সংগ্রহ করে বাজারজাত করতে পেরেছেন। এখন সেই জমি থেকে গড়ে ৩-৪ মণ করে শসা সংগ্রহ করতে পারছেন। তবে আর বড় জোর ৮-১০ দিন এই হারে শসা পাবেন। অথচ ওই জমি থেকে আরও অন্তত দেড় মাস এক-দুই দিন পর তিনি শসা শসা সংগ্রহ করতে পারতেন। কিন্তু প্রখর রোদ আর তীব্র দাবদাহের কারণে শসার গাছ মরে যাচ্ছে। যেগুলো বেঁচে আছে, সেগুলোর মধ্যেও অধিকাংশ গাছ ফুলে গেছে। ফলে ওই জমি থেকে এখন সবমিলিয়ে ১০ মণ শসাও হয়তো আরও পাওয়া যাবে না।
আলতাফ বলেন, এই জমিতে শসা চাষ করতে আমার প্রায় ১ এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন দেশি জাতের এই শসা ১২-১৪শ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসেবে এক সপ্তাহেই আমার টাকা উঠে যেত। কিন্তু গাছ গরমের কারণে মরে যাওয়ায় আর ফুলে যাওয়ায় সেটি হয়নি। প্রথম দিকে ৩০ হাজার টাকার মতো শসা বিক্রি করতে পেরেছি। এর পর গত প্রায় ১৫ দিনের টানা খরাতে গাছ মরে যেতে শুরু করে। জমিতে পানি সেচ দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে। পানি সেচ দেওয়ার পরে নিচ থেকে মাটির গরম উঠে গাছ আরও বেশি মরে যাচ্ছে।’
দুর্গাপুরের পালি গ্রামের মোস্তাক হোসেন জানান, তাঁর প্রায় ১৫ শতক জমিতে থাকা বেগুন গাছ তীব্র দাবদাহ আর রোদের কারণে মরে গেছে। সর্বশেষ গাছে যেসব বেগুন এসেছিল, সেগুলো রোদে পুড়ে গাছে হলুদ হয়ে আছে অথবা মাটিতে পড়ে কালো হয়ে আছে। এখন বেগুন গাছগুলো তুলে ফেলতে হবে। অথচ আরও অন্তত ৬ মাস বেগুন পেতেন তিনি ওই জমি থেকে। চাইলে আগামী বছর পর্যন্ত গাছগুলো টিকিয়ে রাখা যেত। কিন্তু দাবদাহে সব শেষ হয়ে গেছে তাঁর। জমিতে বেগুন চাষ করতে গিয়ে যে ৪৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল, সেটিও উঠেনি।
পবার পটল চাষি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার এক বিঘা জমিতে পটল আছে। কদিন আগেও ভালোই পটল উঠছিল। সপ্তাহে অন্তত ৮-৯ মণ পটল উঠানো যেত। এখন ৩ মণ পটলও হচ্ছে না। প্রচণ্ড গরমের কারণে গাছ মরে যাচ্ছে। পটলও হলুদ হয়ে যাচ্ছে গাছেই। এভাবে আর কয়দিন থাকলে একটা গাছও টিকানো যাবে না।’
বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ সুলতান জনি বলেন, ‘তীব্র দাবদাহের কারণে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। পানি সেচ দিয়েও রাখা যাচ্ছে না ফসল। মাটি থেকে গরম ওপরের দিকে উঠছে। এই অবস্থায় পানি ফসলের পাতায় স্প্রে করা দরকার। কিন্তু আমাদের দেশের জমিতে সেই ব্যবস্থা নাই। যার কারণে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। গাছের আম তো ব্যাপক হারে ঝরে যাচ্ছে।’
তানোরের চাষি আমজাদ আলী বলেন, পানির ওভাবে আমার জমির ভুট্টা নষ্ট হয়ে গেছে। পানি সেচ দিলেও তেমন লাভ হচ্ছে না। ভুট্টা গাছেই শুকায় যাচ্ছে। বড় হচ্ছে না।’
বাগমারার পানচাষি আসাদুল হক বলেন, ‘তীব্র খরায় পানের গাছের ওপরের অংশ মরে যাচ্ছে। পানের ফলন কমে গেছে। পান বরে (বরজ) রাখায় মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। একদিন পর সেচ দিয়েও কুব একটা কাজে আসছে না। আবার পানিরও সঙ্কট। চাইলেও ঠিকমতো পানি সেচ দেওয়া যাচ্ছে না।’
তবে রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) শারমিন সুলতানা বলেন, গরমে ফসলের ক্ষতি হবে। কিন্তু রাজশাহীতে কি পরিমাণ ফসল ক্ষতি হয়েছে, সেই আমাদের কাছে এখনো নাই। তবে আমরা কৃষকদের জমিতে পানি সেচ দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। তাতে ফসলের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাকে অনেকটা।’