২০০ কোটি টাকার সোনা মেরে দেওয়ার ক্ষোভ এবং নতুন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভারতে সোনা চোরাচালান নির্বিঘ্ন রাখতেই সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন আক্তারুজ্জামান শাহীন। ওই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শাহীনের সোনার চালান পাচারে বাধা হচ্ছিলেন এমপি আনোয়ারুল আজীম। নতুন এই সিন্ডিকেটকে সাবেক এক এমপি নেতৃত্ব দিতেন বলে শোনা যাচ্ছে।
পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে সূত্রটি বলছে, নাম শোনা যাওয়া সাবেক ওই এমপি সোনাসহ অবৈধ পণ্য চোরাচালান সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত হলেও এমপি আনোয়ারুল আজীম হত্যার পরিকল্পনায় তাঁর যুক্ত থাকার সম্ভাবনা কম। এরপরও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এই হত্যার ঘটনায় ঢাকায় গ্রেপ্তার এক নারীসহ তিনজনকে গতকাল শুক্রবার আট দিন করে রিমান্ডে নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। জিহাদ হাওলাদার নামে আরও একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সংস্থাটি বলছে, এমপির মরদেহ টুকরা টুকরা করেছে জিহাদ নামের এই কসাই।
চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গিয়ে ১৩ মে খুন হন ঝিনাইদহ–৪ (কালীগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগের এমপি আনোয়ারুল আজীম।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ও ঝিনাইদহের বিভিন্ন সূত্র বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আক্তারুজ্জামান শাহীন দুবাই থেকে সোনা কিনে সীমান্তপথে ভারতে পাচার করেন। তাঁর সোনার চালান সীমান্ত পার করাতে সহযোগিতা করতেন তাঁর বন্ধু এমপি আনোয়ারুল আজীমের সিন্ডিকেট। বিনিময়ে সিন্ডিকেট কমিশন পেত। কিন্তু মাঝে মাঝেই চালান ধরা পড়েছে জানিয়ে সোনা মেরে দিত ওই সিন্ডিকেট। এভাবে কয়েক চালানে প্রায় ২০০ কোটি টাকার সোনা মেরে দেয় এমপির সিন্ডিকেট। এ নিয়ে এমপির ওপর ক্ষিপ্ত হন আক্তারুজ্জামান শাহীন। তবে ক্ষমতাসীন দলের এমপির সঙ্গে দ্বন্দ্বে না গিয়ে তিনি সোনা পাচারে সীমান্তের আরেকটি সিন্ডিকেটকে বেছে নেন। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক ওই এমপি।
সূত্রগুলো বলছে, আক্তারুজ্জামান শাহীন সোনা পাচারের কাজ নতুন সিন্ডিকেটকে দেওয়ায় তাঁর সঙ্গে এমপি আনোয়ারুল আজীমের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছিল ছয় মাসের বেশি সময় ধরে। সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ও পাচারের কাজ সিন্ডিকেটে ফিরিয়ে আনতে এমপি নানা চেষ্টা করেন। শাহীনের সোনার কয়েকটি চালান পাচারে বাধার সৃষ্টি করেন। এ নিয়েও ক্ষুব্ধ হন আক্তারুজ্জামান শাহীন। বিষয়টি মীমাংসার জন্য একাধিকবার বৈঠকের পরিকল্পনা করলেও শেষ পর্যন্ত শাহীন বসেননি। নতুন সিন্ডিকেট থেকেও তিনি বের হতে চাননি। তাই একপর্যায়ে সোনা চোরাচালান নির্বিঘ্ন রাখতে এমপি আনোয়ারুলকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন ও পরিকল্পনা করেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এমপি হত্যার পরিকল্পনায় ওই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রকের কোনো ভূমিকা আছে কি না, তা এখনো জানা যায়নি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ডিএমপির শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, আপাতত তাঁরা আনোয়ারুলের মরদেহ উদ্ধার এবং ঘটনায় জড়িত পলাতক কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছেন। এমপি হত্যার পরিকল্পনায় ওই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা থাকার সম্ভাবনা কম।
ঝিনাইদহ-৪ আসনের টানা তিনবারের এমপি আনোয়ারুল কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ১১ মে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। প্রথমে ওঠেন কলকাতার বরাহনগরে বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে। ১৩ মে চিকিৎসক দেখানোর কথা বলে সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি নিখোঁজ হন। ১৮ মে স্থানীয় থানায় জিডি করেন গোপাল। তদন্ত শুরু হয় দুই দেশে। গত বুধবার সকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, নিউ টাউনের অভিজাত এলাকা সঞ্জীবা গার্ডেনসের এক ফ্ল্যাটে হত্যার পর আনোয়ারুলের মরদেহ টুকরা টুকরা করা হয়।
এক ফোঁটা রক্ত ছাড়া আর আলামত নেই
ঢাকা ও কলকাতায় গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যে এমপি আনোয়ারুল হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার মতো কোনো আলামত খুঁজে পায়নি দুই দেশের পুলিশ। কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনসের ওই ফ্ল্যাটের দেয়ালে রয়েছে কেবল এক ফোঁটা রক্তের দাগ। এই হত্যার ঘটনায় কলকাতায় সন্দেহভাজন তিনজনকে গ্রেপ্তারের কথা বাংলাদেশ পুলিশকে জানিয়েছে সেখানকার পুলিশ। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বনগাঁ থেকে গ্রেপ্তার করা হয় জিহাদ হওলাদার নামের এক যুবককে।
পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি বলছে, পেশায় কসাই জিহাদকে মুম্বাই থেকে আনোয়ারুল আজীমকে খুন করার জন্য কলকাতায় আনা হয়। জেরার পর বৃহস্পতিবার রাতে জিহাদকে ভাঙ্গরের একটি স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কারণ, জেরায় তিনি সেখানে এমপির মরদেহের টুকরা ফেলার কথা বলেছেন। তবে ওই রাতে সেখানে কিছু না মেলায় গতকাল আবার তাঁকে নিয়ে সেই স্থানে যান সিআইডির কর্মকর্তারা। এই হত্যার আলামত সংগ্রহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জিহাদকে গতকাল ১২ দিনের হেফাজতে নিয়েছে সিআইডি।
ডিএমপির কমিশনার হাবিবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, এমপি আনোয়ারুল হত্যার মূলে রয়েছেন আক্তারুজ্জামান শাহীন। তাঁকে না পাওয়া পর্যন্ত অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলছে না।