রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বাইরে স্ট্রেচারে পড়ে আছে জেলার পীরগঞ্জের আবুল কাশেমের বাবার লাশ। তিনি কাঁদছেন। তবুও হাত বাড়িয়ে তাঁর কাছে বকশিশ চাচ্ছেন আয়া। লাশ নিতে অ্যাম্বুলেন্স চালক দাবি করছেন মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া, প্রায় ৪ হাজার টাকা। লাশটি ফুলতে শুরু করেছে। পদে পদে বাধা পেরিয়ে কী করে বাবার লাশ বের করবেন- এই চিন্তায় কাশেমের চোখে জল। শেষমেশ আয়াকে ২০০ ও চালককে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় রাজি করিয়ে তাঁরা মুক্তি পান।
বাবার লাশ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে বসা কাশেম বললেন, 'নরক থেকে বের হলাম। মরেও শান্তি পাননি আমার বাবা। আসার পর থেকে পদে পদে খরচ করেছি। তার পরও চিকিৎসার অভাবে মারা গেলেন বাবা। শেষে তাঁর লাশ নিয়েও শুরু হলো বাণিজ্য। তাঁরা কতটা নিষ্ঠুর তা এখানে না এলে বুঝতেই পারতাম না। চিকিৎসার এই স্থানটি তারা কলঙ্কিত করেছে।' কাশেমের বাবাকে নিয়ে হৃদয়বিদারক এ ঘটনাটি গত ২৩ জুনের।
সরেজমিন দেখা গেছে, এই হাসপাতালে কার্যত কোনো চিকিৎসাসেবা নেই। পুরো ব্যবস্থাটাই নিয়ন্ত্রণ করে দালাল চক্র। চরম অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এখানে দুর্নীতিও লাগাম ছাড়া।
হাসপাতালের লাশ-বাণিজ্যের স্থানটির পাশেই সর্দার অফিস। পেছন দিয়ে একটু এগিয়ে গেলে নতুন রোগী ভর্তির কাউন্টার। এখানে হলুদ জ্যাকেট পরে দাঁড়িয়ে আছেন ৯-১০ যুবক। প্রত্যেকের হাতে ট্রলি। এখানে প্রতি ২ মিনিটে একজন করে রোগী আসছেন। তাঁদের বাইরে দাঁড় করিয়ে জ্যাকেটধারী ছুটছেন কাউন্টারে। নাম ও রোগ লেখানোর পর্ব শেষ করে ভর্তি ফি ৩০ টাকার স্থলে নিচ্ছেন ২০০ টাকা।
কেউ টাকা দিতে না চাইলে রোগীকে ফেলে রাখা হচ্ছে বাইরেই। মিটমাট হলেই কেবল স্ট্রেচারে তোলা হচ্ছে রোগীকে। গন্তব্যে নিয়ে দিতে হচ্ছে আরও ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।
পাশের উপজেলা গঙ্গাচড়া থেকে আসা আজমেরি বেগমকে ট্রলিতে করে নেওয়া হচ্ছে মেডিসিন ওয়ার্ডে। তাঁর পিছু নিয়ে দেখা গেল, ট্রলিম্যান ওয়ার্ডের মেঝেতে নামিয়ে দিয়েই দাবিমতো নিলেন ২০০ টাকা। কিছুক্ষণ পর ডিউটি ডাক্তার এসে রোগী দেখে একটি স্লিপে নানা রকম টেস্টের (পরীক্ষা) তালিকা ধরিয়ে দেন। এ সময় ডাক্তারের পাশে উপস্থিত হন বেশ কিছু অপরিচিত দালাল। কোনো অনুমতি ছাড়াই তাঁরা রোগীর শরীর থেকে নিয়ে নেন রক্তের নমুনা। বলা হলো, 'এখন ১ হাজার দেন, বাকি ৩ হাজার দেবেন রিপোর্ট হাতে নিয়ে।'
রোগীর সঙ্গে থাকা এক স্বজন জানতে চাইলেন কী পরীক্ষা? কেন করাতে হবে?- এসবের কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু বলা হলো, 'যা বলছি দেন। ডাক্তার চলে গেলে এই রিপোর্টও দেখাতে পারবেন না।' নিরুপায় হয়ে তাঁদের দেওয়া হলো আগাম ১ হাজার টাকা।
পাশের বেডে শুয়ে আছেন মরিয়ম খাতুন নামে একজন গৃহবধূ। নতুন রোগীর স্বজনকে তিনি বললেন, এখানে আসার পর সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে দালাল চক্র। তারাই ফোন করে তাদের নিজেদের অ্যাম্বুলেন্স ও ম্যানেজ করা ডাক্তার নিয়ে আসে। দালালচক্র রোগীকে তুলে নেয় অ্যাম্বুলেন্সে। শরীর থেকে সংগ্রহ করে নেয় রক্ত। নিয়ে যায় তাদের পরিচিত ক্লিনিকে। তারপর টেস্ট করে তিন গুণ ফি আদায় করে।
রোগী ভর্তিতে সিন্ডিকেট :রোগী ভর্তিতে কর্মচারী সিন্ডিকেটের মূলহোতা হলেন এই হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি শাহিনুর রহমান শাহিন ও সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান নয়ন। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় দালালচক্রের অর্ধশতাধিক সদস্য কাজ করেন। দূরদূরান্ত থেকে সাধারণ রোগীরা এসে পড়েন এই সিন্ডিকেটের খপ্পরে।
এখানকার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রোগী ভর্তি থেকে প্রতিদিন এ সিন্ডিকেটের আয় ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা। জানা গেছে, ভর্তি ফির অতিরিক্ত ১৭০ টাকার মধ্যে ৫০ টাকা পান সিন্ডিকেটের প্রধান শাহিন ও নয়ন।
এ বিষয়ে জানলে চাইলে শাহিনুর নিজে এ কাজে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। তবে ভর্তিতে বাণিজ্য হচ্ছে বলে স্বীকার করেন তিনি। তাঁর মতে, এই তৎপরতায় কর্তৃপক্ষ জড়িত রয়েছে।
চোরের পেটে রোগীর ওষুধ :এখানে কিছুদিন আগে চোরাই ওষুধসহ এক নারীকে হাতেনাতে ধরে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। পরে মামলা হয়। তিনি পুলিশের কাছে অভিযুক্তদের নাম-পরিচয় বলে দেন। এর পরও স্টোরসহ বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে থেমে থাকেনি ওষুধ চুরির ঘটনা। চুরি হওয়া ওষুধ হাসপাতালের আশপাশের বিভিন্ন দোকানে বিক্রি হয় অনেকটা খোলামেলাভাবেই।
হাসপাতাল থেকে মূল্যবান অ্যান্টিবায়েটিক স্যালাইন সেপ্রোক্সি আইভি, মেট্রো আইভি, ইনজেকশন, সিরিঞ্জ, গজ, অপারেশনের সুতাসহ বিভিন্ন প্রকার ওষুধ প্রতিদিনই চুরি হচ্ছে। গোয়েন্দা তদন্তের তথ্যমতে, গত দুই বছরে হাসপাতালের সিল সংবলিত এবং সিল ছাড়া দেড় কোটিরও বেশি টাকার ওষুধ চুরি করে বাইরে বিক্রি করা হয়। স্টোরের দায়িত্বরতদের মাধ্যমে চক্রটি ওষুধ চুরির বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছে।
অভিযোগ রয়েছে, ওষুধ চুরির মূলহোতা সিনিয়র স্টোর অফিসার গোলাম রসুল রাখি ও স্টোরকিপার বেলাল হোসেন। তাঁদের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন আরও কয়েকজন নার্স। তাঁরা হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়, ওয়ার্ড মাস্টার, সুইপারসহ বিভিন্ন শ্রেণির র্কমচারীদের ব্যবহার করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চোর সিন্ডিকেটের কাছ থেকে দোকান মালিকরা অর্ধেক দামে ওষুধগুলো কিনে নেন। পরে সিল দেওয়া ওষুধ গ্রামে এবং সিল ছাড়া ওষুধ হাসপাতালের আশপাশের এলাকায় বিক্রি করেন তাঁরা।
এ ব্যাপারে কথা বলতে গোলাম রসুলের মোবাইলে কল করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তবে স্টোরকিপার বেলাল বলেন, ওষুধ চুরি করে বাইরে বিক্রি করে শুনেছেন। তাঁরা চাহিদামতো ওষুধ দিয়ে দেওয়ার পর নার্স ও ওয়ার্ডবয়রা এই কাজ করতে পারেন। তিনি স্বীকার করেন, এর আগে বাইরে ওষুধ বিক্রির সময় বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছিল।
পরীক্ষা হয় না পরীক্ষাগারে: এখানে পরীক্ষাগার কার্যত অচল। রংপুরের পাশে গাইবান্ধা থেকে এসেছেন উম্মে কুলসুম। জানালেন লিভারের সমস্যার জন্য সপ্তাহখানে আগে এসেছেন তিনি। রমেক হাসপাতাল মোড়ে গাড়ি থেকে নামলে কয়েকজন তাঁকে ভালো চিকিৎসকের কথা বলে একটা চেম্বারে নিয়ে যায়। বিভিন্ন পরীক্ষা শেষে তারা আদায় করে প্রায় ৮ হাজার টাকা। পরীক্ষার প্রতিবেদন নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি কিছু ওষুধ লিখে দেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, দালালরা তাঁকে নিয়ে প্রতারণা করেছে। আসলে লিভারের কোনো পরীক্ষাই করেনি তারা।
জানা গেছে, বাইরে রোগী ভাগানো চক্রের মূলহোতা হলেন হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের প্রচার সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম সুমন। এই কাজে তাঁকে সহযোগিতা করে ৩৫ থেকে ৪০ সদস্যের একাধিক টিম। দালালরা রোগীকে বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যায়। তবে অভিযুক্ত সিরাজুলের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করেন এখানকার চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক আলী আহম্মেদ মজুমদার বাবু। তাঁর লোকজন ছাড়া কোনো রোগী রক্ত কিনতে পারবেন না। একইভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য শরীর থেকে রক্তও নিতে পারবে না। রক্তের দাম নেওয়া হয় তিন গুণ।
লাশেই বাণিজ্য কোটি কোটি টাকার: হাসপাতালের লাশ পরিবহন চক্রের প্রধান হোতা শাহজাহান হাওলাদার ম্যাক্স। তার নেতৃত্বে বহিরাগত তুষার, শরিফুল, আসাদ বাহিনী এসব কাজ করে। অ্যাম্বুলেন্সে লাশ বহন ও বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যাওয়াও নিয়ন্ত্রণ করে তারাই। অল্প দূরত্বেই ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায় যেতে বাধ্য করা হয়। বাইরের কোনো গাড়ি এখানে প্রবেশের সুযোগ নেই।
তথ্য বলছে, স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক এই হাসপাতালে ২৫ থেকে ৩০ জন রোগী মারা যান। সেই হিসাবে প্রতিদিন ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা মৃতদের স্বজনের কাছে থেকেই আদায় করা হয়।
ময়লার স্তূপ: এই হাসপাতালে প্রতিদিন অন্তত দেড় হাজার রোগী থাকেন। চিকিৎসক, নার্স, রোগীসহ হাসপাতালের যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা ও মেডিকেল বর্জ্য জমা হয় এখানে। হাসপাতালের নতুন ভবনের সামনে, সাইকেল গ্যারেজের বিপরীতে, পূর্ব গেটের প্রবেশমুখসহ হাসপাতাল চত্বরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে ময়লা-আবর্জনা। পর্যাপ্ত ডাস্টবিন না থাকাসহ সচেতনতার অভাবে সেখানে প্রতিনিয়ত খাবারের উচ্ছিষ্ট ফেলছেন রোগীর স্বজনরা। আর হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাও ফেলছেন মেডিকেল বর্জ্যসহ নানা আবর্জনা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রংপুর মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, নির্দিষ্ট জায়গায় মেডিকেল বর্জ্যসহ ময়লা-আবর্জনা ফেলার ব্যবস্থা করা হলে আমরা এই স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে বাঁচতে পারতাম। সবার সুস্থতার কথা চিন্তা করে হাসপাতালের চারপাশ দ্রুত পরিস্কার করতে হবে।
হিমঘর অচল, কাজ করে না যন্ত্রপাতি: লাশ রাখার হিমঘরে ফ্রিজে মোট ৩০টি লাশ রাখার কথা। এই ফ্রিজগুলোর সবই নষ্ট। তিন বছরেরও বেশি সময় নষ্ট হয়ে পড়ে আছে রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের দুটি সিটিস্ক্যান মেশিন। ফলে হাসপাতালের বাইরে পরীক্ষা করাতে বেশি টাকা এবং দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে রোগীদের।
হাসপাতালে সিটিস্ক্যানে পরীক্ষার ধরন বিশেষে সর্বনিম্ন ২ থেকে ৪ হাজার টাকা নেওয়া হতো। একই ধরনের পরীক্ষা বাইরে করালে ৪ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়।
হাসপাতালের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাজমুন নাহার বলেন, তিন বছর ধরে মেশিনটি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। সিটিস্ক্যান মেশিনটি খুবই জরুরি। রোগীদের ভোগান্তি হচ্ছে। বিভিন্ন ওয়ার্ডের গুরুতর অসুস্থ রোগীদের বাইরে নিয়ে যেতে হচ্ছে স্বজনদের।
কর্তৃপক্ষের ভাষ্য: রমেক হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. আরশাদ হোসেন বলেন, বর্জ্য ফেলার নির্দিষ্ট স্থান আছে। এর পরও অনিয়ম হলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভারপ্রাপ্ত পরিচালক বলেন, তিনি এক মাসেরও কম সময় ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর চেষ্টা আছে সব অনিয়ম বন্ধ করে হাসপাতালকে একটি দালাল ও দুর্নীতিমুক্ত সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার। তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাবেন, তবে কতটুকু সম্ভব হবে তা বলা যাচ্ছে না।
দুর্নীতি ফাইল চাপা: রমেক হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. ফরিদুল হক দায়িত্বে ছিলেন দেড় বছর। তারপর পরিচালকের দায়িত্বে আসেন ডা. রেজাউল করিম। তিনি ১ বছর ৪ মাস দায়িত্ব শেষে গত জুনে অবসরে যান। কিন্তু এই দুই পরিচালকের সময় গত ৩ বছরে রমেক হাসপাতালে টেন্ডার-বাণিজ্য থেকে শুরু করে দুর্নীতি-অনিয়ম অর্থ আত্মসাৎ ছিল অনেকটা ওপেন সিক্রেট। আগে ছোট-বড় ঠিকাদারদের যোগসাজশে হাসপাতালের বিভিন্ন কেনাকাটা, রুম মেরামত, ডাস্টবিন মেরামত, বিদ্যুৎ সংস্কার, মনগড়া বিল-ভাউচারসহ নানা কর্মকাণ্ডে গড়ে তোলা হয় শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ ছাড়া ভুয়া জখমি সনদ দিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে একাধিক চক্র।
ডা. ফরিদুল হক দাবি করেন, তিনি কোনো অন্যায় কাজ করেননি। নিয়মমতোই হাসপাতাল চালিয়েছেন। আর ডা. রেজাউল করিম নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, 'ইচ্ছা থাকলেও অনেক কাজ করা যায়নি। আমি একাধিক পক্ষের কাছে জিম্মি ছিলাম। বাধ্য হয়েছি ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে।'