বাংলাদেশে গত অগাস্ট মাসে রাজনৈতিক পালাবদলের পর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের সঙ্গে পণ্য রপ্তানির পরিমাণ আচমকা ২৮ শতাংশ কমে যাওয়া এই দাম বৃদ্ধির পেছনে একটি বড় কারণ হতে পারে। যদিও সেপ্টেম্বরে কিছুটা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে দেখা গেছে, চলতি অক্টোবর মাসে বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থল বন্দরের নানা কারণে বাণিজ্য আবারও ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভারত-বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর কিছু বিধিনিষেধ তুলে নিলেও, বাজারে পেঁয়াজসহ চাল, ভোজ্য তেল ও চিনির দাম আবারও বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, ভারত সরকারের এ পদক্ষেপের মূল কারণ মহারাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচন।
একাধিক ভারতীয় গবেষণা সংস্থা সতর্ক করে জানিয়েছে, যদি বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘায়িত হয়, তবে ভারতের রপ্তানিমুখী শিল্প মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং বাংলাদেশে রপ্তানির পরিমাণ দ্রুত কমতে পারে।
ভারতের সবচেয়ে পুরনো রেটিং এজেন্সি ‘ক্রিসিল’ যেমন তাদের এক রিপোর্টে বলেছে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ অবশ্যই আগামী দিনে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে বড়সড় প্রভাব ফেলবে – তবে তাতে সব খাতে বা সব শিল্পে সমান প্রভাব পড়বে না, কোনোটায় বেশি বা কোনোটায় কম হবে।
‘আইডিয়াজ ফর ইন্ডিয়া’ থিঙ্কট্যাঙ্কের তরফে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আবার বলা হয়েছে, ভারত থেকে বাংলাদেশে বর্ষাকালীন বা খরিফ কৃষিপণ্যের রফতানি এবার ভীষণভাবে মার খেতে পারে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে ‘অবাধ বাণিজ্য চুক্তি’ (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা ‘সেপা’) নিয়ে বহু বছর ধরে আলোচনা চলছিল, এখন তার ভবিষ্যৎ নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
চুক্তিটি অদূর ভবিষ্যতে সই করা যাবে, এমন সম্ভাবনা দেখছেন না কেউই।
সব মিলিয়ে, ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য যে এই মুহুর্তে একটা প্রবল অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডেটা কী বলছে?
ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় প্রতি মাসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে, তা থেকেই স্পষ্ট যে গত অগাস্টে বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি একটা বড়সড় হোঁচট খেয়েছিল।
ওই ডেটা বলছে, গত বছরের আগস্টে যেখানে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রায় ৯৪৪ মিলিয়ন বা ৯৪ দশমিক চার কোটি ডলারের পণ্য (‘মার্চেন্ডাইজ’) রপ্তানি করা হয়েছিল, ২০২৪-এর আগস্টে সেটাই কমে দাঁড়ায় মাত্র ৬৮১ মিলিয়ন বা ৬৮ দশমিক এক কোটি ডলারে।
ফলে গত বছরের অগাস্টের তুলনায় চলতি বছরের অগাস্টে ভারতের রপ্তানি কমেছিল ২৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
অথচ তার ঠিক আগের মাসেই (জুলাই ২০২৪) রপ্তানির পরিমাণ তার আগের বছরের জুলাইয়ের তুলনায় ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়েছিল। গত বছরের জুলাইতে ৭২৩ মিলিয়ন ডলারের জায়গায় ২০২৪ এর জুলাইতে রফতানি করা হয়েছিল ৮০৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য।
৫ অগাস্ট বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নাটকীয় পরিস্থিতিতে দেশ ছাড়তে হয় – আর তার তিনদিন পর দায়িত্ব নেয় মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
সে সময় দিনের পর দিন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সীমান্তের স্থল-বন্দরগুলোতে স্থবিরতার প্রভাব নিশ্চিতভাবেই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ওপর পড়েছে।
তবে দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক আরআইএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. প্রবীর দে মনে করছেন, আগস্টের অনিশ্চয়তা সেপ্টেম্বরে বেশ কিছুটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, চলতি বছরের অগাস্টে বাংলাদেশে ভারতের রফতানি ও সে দেশ থেকে আমদানি, দুটোই মারাত্মকভাবে কমেছিল। কিন্তু পরের মাসেই সেটা কিছুটা পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।
দিল্লিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডেটাও বলছে, ২০২৩-র সেপ্টেম্বরে যেখানে ভারত বাংলাদেশে প্রায় ৮৭০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল, ২০২৪-র সেপ্টেম্বরে সেখানে প্রায় ৮৬১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করা সম্ভব হয়েছে।
তবে, এর একটা কারণ হতে পারে, পেট্রাপোল বা হিলি স্থলবন্দরে আগস্ট মাসে আটকে থাকা পণ্য অবশেষে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে ঢুকতে পেরেছে এবং সেই মাসের পরিসংখ্যানে যুক্ত হয়েছে।
কোন পণ্যটা কম, কোনটা বেশি?
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান খুঁটিয়ে দেখলে অবশ্য দেখা যাবে যে, বাংলাদেশে সব ধরনের পণ্যের রপ্তানিই যে কমেছে, তা কিন্তু নয়।
বরং কোনো কোনো বিশেষ পণ্যর রপ্তানি আগস্ট মাসেও বেড়েছে।
যেমন ফার্মাসিউটিক্যাল প্রোডাক্টস বা ওষুধের রপ্তানি (তার আগের বছরের অগাস্ট মাসের তুলনায়) ৩২ শতাংশ বেড়েছিল।
তৈরি পোশাক শিল্পের অপরিহার্য কাঁচামাল তুলার রপ্তানিও বেড়েছে ১৩ শতাংশ।
একইভাবে আলু-সহ বিভিন্ন শাকসব্জির রফতানি বেড়েছিল ১৮ শতাংশ। তামাক, তামাকের বিকল্প, তামাকজাত দ্রব্যর রপ্তানি বেড়েছিল রেকর্ড ৩৯২ শতাংশ!
কিন্তু, এগুলো ব্যতিক্রম হিসেবেই ধরতে হবে, কারণ বেশির ভাগ পণ্যের ক্ষেত্রেই ভারত থেকে রফতানির পরিমাণ সাঙ্ঘাতিকভাবে কমেছে।
যেমন ফল, বাদাম, শুকনো ফল ইত্যাদির আমদানি কমেছিল প্রায় ৫৬ শতাংশ। আর বিভিন্ন সিরিয়াল বা শস্যদানার (যেমন ডাল ইত্যাদি) ক্ষেত্রে এই পরিমাণটা ছিল ৯৫ শতাংশ!
চকোলেট তৈরির জন্য দরকারি কোকো বা কোকো প্রিপারেশনের আমদানি কমে যায় ৮৭ শতাংশ। সিল্ক বা রেশম আমদানি কমেছে ৯৪ শতাংশ, খেলনা ও ক্রীড়া সরঞ্জামের ক্ষেত্রে পরিমাণটা ছিল ৮৩ শতাংশ।
কৃষিকাজের জন্য অপরিহার্য রাসায়নিক সারের আমদানিও ৯৪ শতাংশ কমে গিয়েছিল, মানে বলতে গেলে ভারত থেকে বাংলাদেশে সার আসা একরকম বন্ধই হয়ে গিয়েছিল!
বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত ক্রেতারা গত কয়েক সপ্তাহে বাজারে কাশ্মীরি আপেল বা একটা সামান্য চকোলেট কিনতে গিয়েও যে দাম শুনে অবাক হয়েছেন – তার কারণটা বোঝা তাই খুব কঠিন নয়!
বৃহত্তম স্থলবন্দরে ‘শুধু ছুটি আর ছুটি’
ভারতের পেট্রাপোল ও বাংলাদেশের বেনাপোলের মাঝে সীমান্তে যে স্থলবন্দর রয়েছে, দু’দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্যের আদানপ্রদান হয় সেই পথ দিয়েই। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ৩০ শতাংশেরও বেশি এই একটি বন্দরই সামলায়।
পেট্রাপোল প্রান্তে অবস্থিত ইন্টিগ্রেটেড চেক পোস্ট বা আইসিপি-টি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম স্থলবন্দরও বটে।
কিন্তু কথায় কথায় যেভাবে এই বন্দরে কাজ থমকে যায় এবং পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলোকে দিনের পর দিন সীমান্তে অপেক্ষা করতে হয়, তাতে দুই দেশের ব্যবসায়ীরাই একরকম তিতিবিরক্ত।
যেমন, চলতি অক্টোবর মাসের গোড়াতেই যখন পশ্চিমবঙ্গে শারদীয় দুর্গোৎসব চলছিল, তখন পেট্রাপোল বন্দর টানা পাঁচদিন বন্ধ ছিল।
সে সময় নয় থেকে ১৩ অক্টোবর সেখানে কোনো মাল খালাস হয়নি বললেই চলে।
সেই পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে না হতেই ভারত সরকার জানিয়ে দেয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আগামী ২৪ অক্টোবর পেট্রাপোলে একটি আধুনিক টার্মিনাল ভবন উদ্বোধন করতে আসবেন, তাই নিরাপত্তার কারণে বন্দরের কাজকর্ম আবারও চারদিন বন্ধ রাখা হবে।
এ নির্দেশ অনুযায়ী সোমবার মানে ২১ অক্টোবর থেকে স্থলবন্দরের কাজ বন্ধও হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু শেষ মুহুর্তে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুষ্ঠান বাতিল হওয়ায় মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর বিকাল থেকে পেট্রাপোল আবার চালু হয়েছে।
কলকাতা থেকে বাংলাদেশে নানা ধরনের ‘পেরিশেবল’ বা পচনশীল খাদ্যপণ্য রপ্তানি করেন, এমন একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসির কাছে বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করছিলেন।
‘একজন মন্ত্রী দুইঘণ্টার জন্য একটা অনুষ্ঠানে আসবেন, তার জন্য স্থলবন্দর চারদিনের জন্য বন্ধ রাখতে হবে কেন, এটাই তো বোধগম্য নয়! পৃথিবীর কোনও আধুনিক বন্দরে এত ছুটি থাকতে পারে, ভাবাই যায় না!
‘দুর্গাপূজায় গেল পাঁচদিন, সামনে কালীপূজা আর দিওয়ালিতেও নিশ্চয় তিন-চারদিন ছুটি থাকবে – তারপর ভিআইপি মুভমেন্টের জন্যও ছুটি! শ্রমিক আন্দোলন বা ধর্মঘটের কথা তো ছেড়েই দিলাম!’
সব দেখেশুনে তার মনে হচ্ছে, ‘যেকোনো কারণেই হোক, ভারত সরকার বোধহয় চাইছে না বাংলাদেশে রফতানিটা আবার স্বাভাবিক হোক!’
মহারাষ্ট্রের ভোট ও পেঁয়াজের রাজনীতি
ভারত এই মুহুর্তে বাংলাদেশে রপ্তানি সত্যিই ‘নিরুৎসাহিত’ করছে কী না বলা কঠিন – কিন্তু করলেও একটি ‘স্পর্শকাতর’ পণ্য অবশ্যই তার বাইরে থাকবে, সেটি হল পেঁয়াজ।
তবে তার পেছনে একমাত্র কারণ ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি– যেহেতু মহারাষ্ট্রে বিধানসভা ভোটের আর এক মাসও বাকি নেই।
মহারাষ্ট্রের নাসিক হল ভারতের ‘অনিয়ন ক্যাপিটাল’, আর ওই রাজ্যের ‘অনিয়ন লবি’ রাজনৈতিকভাবেও খুব শক্তিশালী।
দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভারত যখনই বিদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে, মহারাষ্ট্রের পেঁয়াজ চাষীরা বরাবর রাস্তায় নেমে এসে তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পেঁয়াজের মান্ডি বা পাইকারি বাজার অচল হয়ে পড়েছে।
সহজ কারণ, বাংলাদেশে বা নেপালে ডলারে পেঁয়াজ বেচে তারা নিজ দেশের তুলনায় অনেক বেশি দাম পেয়ে থাকেন!
এখন একটানা প্রায় ছয়মাস পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ রাখার পর গত মে মাসে দেশে লোকসভা নির্বাচনের ঠিক মুখে এসে ভারত সরকার সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিল – কারণ ছিল মহারাষ্ট্রের অনিয়ন লবিকে সন্তুষ্ট করা।
তবে, নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও টন প্রতি ৫৫০ ডলারের একটা ন্যূনতম মূল্য বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, সঙ্গে আরোপ করা হয়েছিল ৪০ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক।
তবু এই সিদ্ধান্তের জেরেই প্রায় ছয়মাস পর ভারত থেকে বাংলাদেশে আবার পেঁয়াজ যেতে শুরু করে।
এরপর গত ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত সরকার রফতানির বিধিনিষেধ আরও একবার শিথিল করে, ন্যূনতম দামের শর্ত তুলে নেওয়া হয় এবং রপ্তানি শুল্কও অনেকটা কমানো হয়।
কারণ সেই একই, মহারাষ্ট্রে বিধানসভার ভোট এগিয়ে আসছিল।
পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন, আগামী ২৩ নভেম্বর মহারাষ্ট্রের ভোটপর্ব মেটা পর্যন্ত – অর্থাৎ আরও প্রায় মাসখানেক ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে নতুন করে কোনও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে না।
কিন্তু ইতোমধ্যে ভারতের খুচরো বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৬০ থেকে ৮০ রুপিতে পৌঁছে গেছে, ফলে ভোটের পর কেন্দ্রীয় সরকার পেঁয়াজ নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবে তা বলা মুশকিল।
‘আইডিয়াজ ফর ইন্ডিয়া’ রিপোর্ট
ভারতের প্রথম সারির অর্থনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘আইডিয়াজ ফর ইন্ডিয়া’ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পালাবদলের পর দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে কী প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি-র দু’জন গবেষক, রাধিকা পান্ডে ও রচনা শর্মা সেখানে দেখিয়েছেন, চড়া মূল্যস্ফীতি আর তরুণদের মধ্যে চরম বেকারত্বের কারণে বাংলাদেশে আমদানির চাহিদা বহু দিন ধরেই কমছিল।
এটা বিশেষ করে প্রকট ছিল নন-টেক্সটাইল খাতে।
তারা বলছেন, বাংলাদেশের ডলার সংকটের কারণে আমদানি পরিস্থিতি আরও ‘ভালনারেবল’ হয়ে ওঠে।
আর জুলাই-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা ‘পরিস্থিতিকে এখন আরও অনেক জটিল করে তুলতে পারে’।
ওই গবেষণাপত্রে তারা দেখিয়েছেন, ২০১০-১১ সালেও যেখানে বাংলাদেশে ভারতের বার্ষিক রপ্তানি ছিল মাত্র তিন দশমিক দুই বিলিয়ন ডলারের, ২০২১-২২ অর্থ বছরেই সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ দশমিক দুই বিলিয়ন ডলারে।
কিন্তু তার পরের দু’বছরেই সেই অঙ্কটা আবার কমতে থাকে।
এর পেছনে যেমন বাংলাদেশের ডলার সংকট ও চড়া মূল্যস্ফীতির একটা বড় ভূমিকা ছিল, তেমনই দায়ী ছিল ভারতের নেওয়া বেশ কিছু পদক্ষেপও।
দেশের বাজারে দাম নাগালে রাখার চেষ্টায় ভারত যেভাবে চাল, গম বা চিনির মতো কৃষিপণ্যর রফতানিতে দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, রফতানির অঙ্কটা কমার সেটাও একটা বড় কারণ।
রাধিকা পান্ডে ও রচনা শর্মা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ২০২১-২২ অর্থ বছরেও যেখানে বাংলাদেশ ছিল সারা বিশ্বে ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম রপ্তানি বাজার; ২০২৩-২৪ অর্থ বছরেই তারা কিন্তু নেমে গিয়েছিল আট নম্বর স্থানে।
ফলে ভারত থেকে রপ্তানির এই নিম্নমুখী প্রবণতাটা চলতি বছরের ৫ আগস্ট থেকে নয়, তারও অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল।
তবে ‘অয়েল মিল’ (পশু আহার, কিংবা যা থেকে ভোজ্য তেল তৈরি হয়) বা মশলাপাতির রপ্তানি যে সাম্প্রতিক অস্থিরতার পর ‘পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে’ – গবেষণাপত্রে সে কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
গুজরাটের সুরাটে যে শাড়ি ও ফেব্রিকের কারখানাগুলো বাংলাদেশে বিপুল রপ্তানি করে থাকে, তারাও এই মুহুর্তে ‘নতুন অর্ডারের অভাবে এবং পুরনো পেমেন্ট না-পেয়ে’ ধুঁকছে।
বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানির এক-পঞ্চমাংশই ইঞ্জিনিয়ারিং সামগ্রী, সেগুলোর চাহিদাও হু হু করে কমছে বলে ওই রিপোর্ট সতর্ক করে দিয়েছে।
রেটিং এজেন্সির মূল্যায়ন
ভারতের সবচেয়ে পুরনো রেটিং এজেন্সি, মুম্বাই-ভিত্তিক ‘ক্রিসিল’ গত মাসে তাদের একটি রিপোর্টে দেখিয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ভারতের কোম্পানিগুলোর ‘ক্রেডিট কোয়ালিটিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
তারা ওই রিপোর্টে বলেছে, বাংলাদেশে যা ঘটেছে ভারতের ‘সার্বিক বাণিজ্যে’ তার অভিঘাত সামান্যই হবে – এবং ভারতের কোম্পানিগুলির ক্রেডিট কোয়ালিটিতে (ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা) স্বল্পকালীন প্রভাবও (নিয়ার-টার্ম ইমপ্যাক্ট) হয়তো তেমন একটা পড়বে না।
কিন্তু বাংলাদেশ যে কোম্পানিগুলির জন্য বড় ‘চাহিদার কেন্দ্র’ বা ‘উৎপাদন হাব’, রাজনৈতিক অস্থিরতা খুব বেশিদিন চললে ভারতের রপ্তানি-মুখী সেই শিল্পগুলোর রাজস্ব বা ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সাইকলে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে ক্রিসিল ধারণা করছে।
যে সব শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে ক্রিসিল তার একটি তালিকাও দিয়েছে।
এর মধ্যে আছে কটন ইয়ার্ন মানে গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল, বিদ্যুৎ, জুতো বা ফুটওয়্যার, সফট লাগেজ, এফএমসিজি বা ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস যেমন টমাটো কেচাপ, ফ্রুট জুস, হেলথ ড্রিঙ্ক, ইনস্ট্যান্ট নুডলস ইত্যাদি।
তবে, এই সব শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও সেটা মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে থাকবে বলেই তাদের পূর্বাভাস।
অন্যদিকে, ভারতের শিপ ব্রেকিং ইউনিট (জাহাজ ভাঙার শিল্প), পাট শিল্প ও তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের পরিস্থিতির জন্য অচিরেই লাভবান হবে বলেও ক্রিসিলের ধারণা।
এই সব খাতে পশ্চিমা দেশের যে সব অর্ডার এতদিন বাংলাদেশে যেত, তার অনেকটাই এখন ভারতে চলে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
তবে ভারতের যে সব বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বেচে, তাদের বকেয়া অর্থ পেতে সমস্যা হতে পারে বলেও ক্রিসিল সাবধান করে দিয়েছে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও স্থিতিশীলতার দিকে যে এই মুহুর্তে সতর্ক নজর রাখার প্রয়োজন আছে, ভারতে আর্থিক বিশ্লেষকরা সবাই প্রায় সে বিষয়ে একমত।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি যে সেই রাজনীতির গতিপথের ওপরই অনেকটা নির্ভর করবে, তা নিয়েও তাদের কোনও সংশয় নেই।