জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় মদদ দেওয়ার অভিযোগে ৯ শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গত ১৭ মার্চ সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছিল। তবে সিদ্ধান্তের প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেলেও অভিযুক্ত শিক্ষকদের বরখাস্তের কোনো নোটিশ জারি কিংবা চিঠি দেওয়া হয়নি। এতে শঙ্কায় রয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২৮৯ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কারের নোটিশ জারি করলেও শিক্ষকদের ব্যাপারে নিশ্চুপ প্রশাসন। গুঞ্জন উঠেছে, সমঝোতার মাধ্যমে ফের নিজেদের জায়গায় ফিরে আসবেন অভিযুক্ত শিক্ষকেরা। এরই জন্য তোড়জোড় চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। সহায়তা নিচ্ছেন সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের। এছাড়া অভিযোগ উঠা আরও ১০ শিক্ষকের বিষয়ের তদন্তেও তেমন অগ্রগতি নেই।
বরখাস্ত হওয়া শিক্ষকরা হলেন- সাবেক উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ, সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক আলমগীর কবির, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ ইস্রাফিল আহমেদ রঙ্গন, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মেহেদী ইকবাল, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের তৎকালীন ডিন অধ্যাপক বশির আহমেদ, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান, ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও শেখ হাসিনা হলের তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ হোসনে আরা, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ নাজমুল হোসেন তালুকদার, পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের অধ্যাপক তাজউদ্দীন শিকদার।
১৫ থেকে ১৭ জুলাই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার জেরে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী সিন্ডিকেট সভায় অভিযুক্ত শিক্ষকদের সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এক মাস পেরিয়ে গেলেও অভিযুক্তদের নিয়ে কেন নোটিশ জারি হয়নি তা নিয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
সূত্র মতে, বরখাস্ত হওয়া শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক হোসনে আরা সম্প্রতি একটি ব্যাচের ফলাফল প্রস্তুত কমিটিতে কাজ করছেন। আর ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের মেহেদী ইকবাল একটি ব্যাচের ফিল্ড ট্যুরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
ক্লাসে ফিরতে সম্প্রতি বিভাগের সাবেক-বর্তমান কিছু শিক্ষার্থীদের দিয়ে বরখাস্তের প্রতিবাদ করছেন পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক তাজউদ্দীন শিকদার। এছাড়া সম্প্রতি বিদেশে যেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ছুটি চেয়েছেন সাবেক উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ। তবে এ ছুটি মঞ্জুর করেনি কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও কয়েকজন শিক্ষক শাস্তি মওকুফের জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে তদবিরের চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানিয়েছে বেশ কয়েকটি সূত্র।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার আহ্বায়ক আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, সিন্ডিকেট মিটিংয়ের এক মাস পেরিয়ে গেলেও বরখাস্তের কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়নি। আমাদের ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো অনৈতিক সুযোগ সুবিধা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা চাই, দ্রুত এ সিদ্ধান্ত যেন জারি করা হোক।’
গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক আবদুর রশিদ জিতু বলেন, ‘আমরা প্রশাসনকে বার বার অফিস আদেশ দেওয়ার বিষয়ে বলেছি। হামলার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিয়ে যদি শুধু দায়সারা ধরণের ব্যবস্থা নিয়ে একাডেমিক কার্যক্রমে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে জুলাই আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংশয় থেকেই যাবে। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী, তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বিচারের প্রশ্নে আমরা কোনো ছাড় দেব না। যদি কোনো শিক্ষক হামলাকারী শিক্ষকদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন, তাহলে তাকেও আমরা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করব।’
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘হামলার মদতদাতাদের ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার নৈতিক ভিত্তি আছে বলে আমি মনে করি না। তাদের দ্বারা আন্দোলনকারীদের ফলাফল জালিয়াতিও অসম্ভব কিছু নয়। লাশের ওপর দিয়ে বিপ্লব হলো, বিপ্লবের ফসল এ প্রশাসন এখনো অপরাধীদের দৃশ্যমান বিচার করতে পারেনি। এটা দুঃখজনক।’
অফিস আদেশ জারি না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) এবিএম আজিজুর রহমান বলেন, ‘সিন্ডিকেট সভার বহিষ্কারাদেশের নথি ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে অনুমোদন পেলেই তা কার্যকর হবে।’
কবে নাগাদ অনুমোদন দেওয়া হবে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘খুব দ্রুতই হবে। প্রতিদিন আমি এ আশায় থাকি যে আজকেই অনুমোদন আসবে।’ ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে কার কাছে নথিটি আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সম্ভবত উপাচার্য মহোদয়ের কাছে আছে।’
এ বিষয়ে জাবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. কামরুল আহসান বলেন, ‘বিষয়টি অনুমোদন হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোর দেরির কারণে নোটিশ জারি করতে একটু বিলম্ব হয়ে গেছে। দুই-একদিনের মধ্যেই নোটিশটি জারি করা হবে।’