সংস্কার প্রস্তাবনার যেসব বিষয়ে মতপার্থক্য বিএনপি-জামায়াত-এনসিপির


, আপডেট করা হয়েছে : 01-05-2025

সংস্কার প্রস্তাবনার যেসব বিষয়ে মতপার্থক্য বিএনপি-জামায়াত-এনসিপির

রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে পরিবর্তন বা সংস্কারের প্রশ্নে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় রকমের ভিন্নমত বা পাল্টাপাল্টি অবস্থান দেখা যাচ্ছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে। কিন্তু তাতে ভিন্নমত বা মতপার্থক্য দূর হওয়ার কোনো ইঙ্গিত এখনো পাওয়া যাচ্ছে না।


অন্যদিকে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত। তারা আবার নতুন সংবিধান ও গণপরিষদ নির্বাচন চাইছে। বিএনপিসহ বেশিরভাগ দল থেকে একেবারে বিপরীত অবস্থান নতুন এই দলটি।


প্রশ্ন হচ্ছে, মৌলিক বিষয়গুলোতে সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা কি আদৌ সম্ভব? জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অবশ্য হাল ছাড়তে চায় না। এই কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, দলগুলোর সঙ্গে চলমান আলোচনায় তারা ভিন্নমতের কারণ জানার চেষ্টা করছেন। একইসঙ্গে তাদের সংস্কারের প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা রয়েছে।


রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বড় দলগুলো যখন একে অপরের বিপরীত অবস্থান নিচ্ছে, তখন সংবিধান ও রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কিত মৌলিক বিষয়গুলোয় ঐকমত্য বেশ কঠিন। দলগুলো তাদের দলীয় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে যেতে পারছে না।


গত বছরের পাঁচই অগাস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গঠিত অর্ন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রস্তাব তৈরির জন্য ১১টি কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে সংবিধান, বিচারবিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন, ও পুলিশ- এ সব বিষয়ে ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। 


মূলত সংবিধান সংস্কারের স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আপত্তি, ভিন্নমত বা মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে।


এনসিপি, বিএনপি ও জামায়াতের ভিন্নমত কোন ক্ষেত্রে


এনসিপি বর্তমান সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান চাইছে। সেজন্য তারা গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তুলেছে। দলটির ব্যাখ্যা হচ্ছে, নির্বাচন একবারই হবে। সেই নির্বাচনে যারা জয়ী হবে, তারা প্রথমে গণপরিষদ গঠন করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে। এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই পরে সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। অর্থাৎ তাদের দিয়েই সংসদ গঠিত হবে।


এনসিপি’র এই দাবির সঙ্গে বিএনপি, জামায়াতসহ বেশিরভাগ দলই একমত নয়। এই ইস্যুতেই অন্যান্য দলের সঙ্গে এনসিপি’র মতপার্থক্য বেশি। অবশ্য এনসিপি’র সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, তারা তাদের দাবি নিয়ে এগোবেন। সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত নেবে, সে ব্যাপারে তাদের সমর্থন থাকবে।


প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না বলে সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছে, এ নিয়ে আপত্তি বিএনপির। দলটির জানিয়েছে, এটি রাজনৈতিক দলের নিজেদের সিদ্ধান্তের বিষয়। এ ব্যাপারে পরিবর্তন বা সংস্কারের কোনো প্রয়োজন নেই।


জামায়াত অবশ্য বলছে, সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী এক ব্যক্তি হতে পারেন। দলীয় প্রধান অন্য কেউ থাকতে পারেন। তবে বামপন্থি দলগুলো ও অন্যান্য ইসলামী দল সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত। তারা মনে করে, এক ব্যক্তি তিন পদে থাকার কারণে ‘একনায়ক’ বা ‘স্বৈরাচার’ হওয়ার সুযোগ থাকছে।


এদিকে কোনো ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না- এই সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে একমত নয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সরবরাহ করা স্প্রেডশিটের মন্তব্য বিভাগে দলটি লিখেছে, এ বিষয়ে তারা একমত নয়। বিষয়টি হওয়া উচিত, কোনো ব্যক্তি টানা তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। এছাড়া সরকারের মেয়াদ চার বছর করার প্রস্তাবে সক্রিয় সব দলেরই আপত্তি রয়েছে। তারা পাঁচ বছর মেয়াদের কোনো পরিবর্তন চায় না।


সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা ও সংস্কারের পরিধি নিয়ে চলমান বিতর্কের পাশাপাশি দ্বিমত-ভিন্নমত দেখা দিয়েছে সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং আগে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন করা না করা নিয়েও। শুরু থেকেই বিএনপি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ও আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। আর জামায়াতে ইসলামী বাইরে হরেক কথা বললেও আনুষ্ঠানিক সংলাপে বরাবরই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ও আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানাচ্ছে।


সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচন হলো আসনভিত্তিক কোনো প্রার্থী থাকবে না।  ভোটাররা দলীয় প্রতীকে ভোট দেবেন। একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে সংসদের (নিম্ন কক্ষ) আসন বণ্টন হবে।


এনিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ইত্তেফাককে বলেন, যারা জনগণের প্রত্যক্ষ রায়কে ভয় পাচ্ছেন তারাই আনুপাতিক পদ্ধতির কথা বলছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি বিদ্যমান পদ্ধতিতেই নির্বাচন হতে হবে। 


আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন ও আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না বিএনপির মিত্র রাজনৈতিক দল-জোটগুলোও। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে এলডিপিসহ মিত্র দল-জোটগুলো বিএনপির অবস্থান বা প্রস্তাবের সঙ্গেই সহমত পোষণ করেছে। অন্যদিকে, এই দুটি ইস্যুতে চরমোনাই পিরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি ইসলামি রাজনৈতিক দল এবং তরুণদের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অবস্থানের মিল রয়েছে জামায়াতের সঙ্গে। এই দলগুলোও আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং সংসদের আগে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন দাবি করছে।



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার