‘আমি সেই হতভাগ্য পিতা, যে নিজের সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়েছি’


, আপডেট করা হয়েছে : 23-07-2025

‘আমি সেই হতভাগ্য পিতা, যে নিজের সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়েছি’

পরিবারের ইচ্ছা ছিল তাদের সন্তান সেনা কর্মকর্তা হবে, কিন্তু তৌকিরের স্বপ্ন ছিল—আকাশে উড়বেন। তাই হয়েছিলেন বৈমানিক। দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত বৈমানিক তৌকির ইসলাম সাগরের জীবনপ্রদীপ মাত্র ২৭ বছর আট মাসেই নিভে গেল সেই আকাশে উড়েই। এই তরুণ পাইলটকে অকালে হারিয়ে পরিবার, সহকর্মী, স্বজনরা দিশাহারা সময় পার করছেন।


গতকাল মঙ্গলবার জন্মদাতা মা-বাবা, স্ত্রীসহ অসংখ্য মানুষকে চোখের জলে ভাসিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর। অল্পবয়সে এই তরুণ পাইলটের মৃত্যুতে হৃদয় ভেঙেছে আত্মীয়-স্বজনসহ অসংখ্য মানুষের। গতকাল বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে রাজশাহী নগরীর রেলগেটে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্টেডিয়ামে জানাজা শেষে নগরীর সপুরা গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। এর আগে তাঁকে সেখানে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয়।

গত সোমবার রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগরের মরদেহ গতকাল দুপুর ২টা ৫৫ মিনিটে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে রাজশাহী সেনানিবাসে আনা হয়। সেখানে সামরিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তারা তৌকিরের মরদেহ একটি অ্যাম্বুল্যান্সে করে সেনানিবাসসংলগ্ন নগরীর উপশহরের ৩ নম্বর সেক্টরে তাঁদের ভাড়া বাসায় নিয়ে আসেন। এ সময় এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।


শত শত মানুষ বাড়ির সামনে ভিড় করে তৌকিরকে শেষবারের মতো একনজর দেখতে। বাসার সামনে স্বজন ও এলাকাবাসীর কান্নার রোল পড়ে। সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদেরও শোকার্ত অবস্থায় দেখা যায়। পাইলট তৌকিরের বোন সৃষ্টি খাতুন কান্না ভেঙে পড়ে ‘ও ভাইয়া ও ভাইয়া’ বলে ডাকতে থাকেন। মরদেহ গাড়ি থেকে নামানোর সময় সৃষ্টি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘তুই সকালে একবার কল দিলি না কেন ভাই? একটু কথা কেন বললি না?’

তৌকিরের চাচা নারায়ণগঞ্জ সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক মসিদুল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার বলার কোনো ভাষা নেই।


আমি তাকে নিজে পড়িয়েছি, ঘুম পাড়িয়েছি, কোলেপিঠে মানুষ করেছি, তার বিয়ে দিয়ে গাজীপুর থেকে নিজে গাড়ি চালিয়ে বাসায় নিয়ে এসেছি। আজ সে আর বেঁচে নেই। আমি আর বলতে পারছি না।’

জানাজা শেষে মাঠে তৌকিরের এক নানা নুরুজ্জামান বলেন, ‘তৌকির যেমন মেধাবী ছিল তেমনি ভালো ব্যবহারের অধিকারী ছিল। বড়দের খুব সম্মান করত।’


মরদেহ রাজশাহীতে আসার আগে কথা হয় তৌকিরের চাচার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ওর বাবা নতুন বাসা করছিল নগরীর সপুরায়। সেই বাসায় আর ওঠা হলো না তৌকিরের।’


জানা যায়, পাইলট তৌকিরের বাপ-দাদার বাড়ি চাঁপাইনবাবঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চককীর্তি ইউনিয়নের কৃষ্ণচন্দ্রপুর গ্রামে। তবে তাঁর পরিবারের সদস্যরা রাজশাহী নগরীর উপশহরের ৩ নম্বর সেক্টরে ‘আশ্রয়’ নামের একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। তৌকিরের বাবার নাম তোহরুল ইসলাম, তাঁর মায়ের নাম সালেহা খাতুন। একমাত্র বোন সৃষ্টি পড়ালেখা করেন রাজশাহী ইসলামী ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস তৃতীয় বর্ষে।


গতকাল দুপুরের দিকে নগরীর উপশহরের বাসায় নাতির লাশের অপেক্ষায় থাকা তৌকিরের নানা আজিজুর রহমান বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ে মূর্ছা যাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘তৌকির আমার খুবই আদরের ছিল। খুব ভদ্র ছিল। আমাদের পরিবারের একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র ঝরে গেল।’ প্রতিবেশীরাও শোকে কাতর। তাদের যেন মনে হয়, তাদের নিজের সস্তান বা আপনজন মারা গেছে। শোকাবহ পরিবেশ নগরীর উপশহরজুড়েই।


তৌকিরের খালা, চাচি, নানিসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সব স্বজন এসেছেন রাজশাহীর বাসায়।


রাজশাহী মুক্তিযুদ্ধ স্টেডিয়ামে তৌকিরের জানাজায় অংশ নেয় অসংখ্য মানুষ। নারী-শিশুরা শেষবারের জন্য তাদের প্রিয় সাগরকে একনজর দেখতে ভিড় করে। আবহাওয়া বৈরী থাকায় নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট আগেই পড়ানো হয় জানাজা। জানাজায় অংশ নেয় সর্বস্তরের মানুষ। জানাজার মাঠেও অনেককে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে দেখা যায়।


এ সময় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকিরের জীবনী পড়ে শোনানো হয়। পরে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন তৌকিরের বাবা তহুরুল ইসলাম ও মামা মতিউর রহমান। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তহুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সেই হতভাগ্য পিতা, যে নিজের সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়েছি।’ তিনি সন্তানের জন্য সবার কাছে দোয়া চান।


তৌকিরের মামা শওকত আলী জানান, ছোট থেকেই সাগরের স্বপ্ন ছিল পাইলট হওয়ার। পরিবারের ইচ্ছা ছিল সেনা কর্মকর্তা বানানোর। তবে নিজের স্বপ্নেই অটল ছিল সাগর।


আইএসপিআর জানায়, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম ১৯৯৭ সালের ৯ নভেম্বর রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানাধীন সপুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ২০১৪ সালে পাবনা ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসি, ২০১৬ সালে একই কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হন এবং ২০২০ সালে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) থেকে বিএসসি (এরোনটিকস) ডিগ্রি অর্জন করেন। ফ্লাইট তৌকির ইসলাম ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ২০২৯ সালের ১ ডিসেম্বর জিডি (পি) শাখায় কমিশন লাভ করেন। তিনি চাকরিকালে বিমানবাহিনীর বিভিন্ন ফ্লাইং স্কোয়াড্রন, যেমন—১৫ স্কোয়াড্রনে স্কোয়াড্রন পাইলট এবং ৩৫ স্কোয়াড্রনে স্কোয়াড্রন পাইলট ও অ্যাডজুটেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মোট কমিশন চাকরিকাল পাঁচ বছর সাত মাস ২১ দিন। চাকরিকালে এই কর্মকর্তা দেশে-বিদেশে পেশাগত বিভিন্ন কোর্সে অংশগ্রহণ করে সফলতার সঙ্গে তা সম্পন্ন করেন।


ফিউনারেল প্যারেডের মাধ্যমে চিরবিদায় : গতকাল দুপুরে রাজধানীর কুর্মিটোলায় নিহত পাইলট তৌকির ইসলাম সাগরের সম্মানার্থে ফিউনারেল প্যারেড দেওয়া হয়। প্যারেড অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁনসহ নিহতের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। ফিউনারেল প্যারেড অনুষ্ঠান শেষে দুপুর ১টা ৫ মিনিটের দিকে নিহত পাইলট তৌকির ইসলামের প্রথম জানাজা সম্পন্ন হয়। জানাজা শেষে বিমানবাহিনীর একটি বিমানে তৌকিরের মরদেহ রাজশাহী নেওয়া হয়। মরদেহবাহী বিমানে তৌকিরের বাবা, মামাসহ বিমানবাহিনীর অন্য কর্মকর্তারা ছিলেন।


গত সোমবার সন্ধ্যায় আইএসপিআর জানায়, বিমানবাহিনীর একটি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সোমবার ঢাকার বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি বীর-উত্তম এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়। দুর্ঘটনা মোকাবেলায় এবং বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ওই বিমানের বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি এবং দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি ঢাকার দিয়াবাড়ীতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিধস্ত হয়। এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় আহত সবাইকে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারসহ অ্যাম্বুল্যান্সের সহায়তায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) এবং নিকটস্থ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য দ্রুত স্থানান্তর করা হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক সর্বাত্মক প্রচেষ্টার পর ওই বিমানের বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামকে মৃত ঘোষণা করেন।


সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবাররের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার