বিশ্বে বন্দুক হামলায় প্রাণহানীতে ধনী দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র। চলতি বছরের ১৪৫ দিনে দেশটিতে ২১৪টি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় গড়ে কমপক্ষে চারজন করে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। গেল দুই সপ্তাহে দেশটিতে দুটি বড় হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে দুই বন্দুকধারী। টেক্সাসের একটি প্রাইমারি স্কুলে গত মঙ্গলবার এক বন্দুকধারীর হামলায় প্রাণ গেছে ১৯ শিশু শিক্ষার্থী ও দুই শিক্ষকের।
যুক্তরাষ্ট্রে এখন সড়ক দুর্ঘটনার চেয়ে বন্দুক হামলায় বেশি শিশু প্রাণ হারাচ্ছে বলে সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। টেক্সাসের স্কুলে হামলার মাত্র সপ্তাহ খানেক আগেই নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের বাফেলো শহরে এক দোকানে বন্দুকধারী হামলায় প্রাণ যায় কমপক্ষে ১০ ব্যক্তির। কয়েকদিনের ব্য্যবধানে বড় দুটি বন্দুক হামলার ঘটনার পর দেশটিতে কঠোর অস্ত্র নিয়ন্ত্রন আইন করার জোর দাবি উঠেছে।
গত কয়েক বছর ধরে একের পর এক বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটে চলেছে যুক্তরাষ্ট্রে। বড় ধরনের হত্যাকান্ডের পর প্রায়ই অস্ত্র আইন কঠোর করার দাবি ওঠে দেশটিতে। কিছুদিন আলোচনার পর আবারো সেই দাবি আবেদন হারায়। কিন্তু কেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটি অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে কঠোর করতে পারছে না? এর কারণ যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী গান লবি| যারা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইনের বিপক্ষে। টেক্সাসের হামলার তিনদিনের মাথায় হিউস্টন শহরে প্রায় ৫০ লাখ সদস্যের ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের (এনআরএ) বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই অনুষ্ঠানের ভেন্যুর বাইরে শত শত বিক্ষোভকারী এনআরএ বা গান লবির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তবে সেখানে বক্তারা নতুন কঠোর অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের সম্ভাবনা বাতিল করে দিয়েছেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই অনুষ্ঠানে বলেছেন, অস্ত্র হাতে একজন মন্দ লোককে থামানোর একমাত্র পথ হচ্ছে, অস্ত্র হাতে একজন ভালো মানুষ।
অনেকেই বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র বহনের অধিকার হামলার বড় কারণ। কিন্তু এনআরএ মার্কিন নাগরিকদের অস্ত্র বহনের অধিকারের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষে, অথচ নিজের ঘরে অস্ত্র থাকলে নিরাপদ থাকা যায়, এনআরএর এমন যুক্তি সমর্থন করে অধিকাংশ মার্কিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র বহন ও রাখার অধিকার সংবিধানেই দেওয়া হয়েছে। তাই অস্ত্রের সঙ্গে মার্কিন রাজনীতির সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ১৭৯১ সালে দেশটির সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীতে নাগরিকদের অস্ত্র বহনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেশি বা বিদেশি যেকোনো সরকারের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে নিজের আত্মরক্ষার জন্য ‘সুনিয়ন্ত্রিত’ মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্য হিসেবে প্রত্যেক নাগরিককে অস্ত্র বহনের অধিকার দেওয়া হলো। এ অধিকার এমন সময়ে দেওয়া হয়, যখন যুক্তরাষ্ট্র সদ্য এক ঔপনিবেশিক যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে তখন সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে অনেক কিছু বদলালেও তাদের সংবিধানে সংশোধনীটি রয়ে গেছে।
কংগ্রেসের বিভিন্ন সদস্যকে প্রভাবিত করার জন্য এনআরএ বছরে কোটি কোটি ডলার খরচ করে থাকে। রিপাবলিকান পার্টির নেতাদের মধ্যে এনআরএ’র প্রভাব বেশি। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শপথ নেওয়ার পর এনআরএর’কে বলেছিলেন, মনে রাখবেন, হোয়াইট হাউসে এখন থেকে আপনাদের একজন বন্ধু রয়েছে। তবে শুধু রিপাবলিকান নয়, ডেমোক্র্যাটদের মধ্যেও এনআরএ’র কিছুটা হলেও প্রভাব রয়েছে। যে কারণে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে কোনো কঠোর আইন মার্কিন কংগ্রেসে পাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
টেক্সাসের স্কুলে হত্যাকান্ডের পর শীর্ষ মার্কিন নেতৃত্ব অস্ত্র আইন সময়ের দাবি বলে জানিয়েছে। কিন্তু এই গান লবিদের কাছে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও যে অসহায় তা তার এক বক্তব্যে উঠে এসেছে। টেক্সাসে হামলার নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, কবে আমরা এই গান লবিদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবো?
টেক্সাসে স্কুলে হামলার দুই দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার মার্কিন সিনেটে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস রোধ শীর্ষক একটি বিলের ওপর ভোটাভুটি হয়। কিন্তু রিপাবলিকান সিনেটরদের বিরোধিতায় বিলটি শেষ পর্যন্ত পাস হয়নি। এমন অবস্হায় বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রে অদূর ভবিষ্যতে একটি কঠোর অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।