১৯ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ০৯:৩০:৩৩ অপরাহ্ন
প্রতিমন্ত্রী-সচিব দ্বন্দ্বে স্থবিরতা
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৭-২০২৩
প্রতিমন্ত্রী-সচিব দ্বন্দ্বে স্থবিরতা

প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের দ্বন্দ্বে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মে স্থবিরতা দেখা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, প্রতিমন্ত্রী মো. শরীফ আহমেদ বেশ কয়েক মাস ধরে নিজ দপ্তরে কম সময় দিচ্ছেন। মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিনের হাতে। প্রতিমন্ত্রীকে না জানিয়ে সচিব অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিচ্ছেন। তবে প্রতিমন্ত্রীও ইদানীং কোনো কোনো নথিতে দ্বিমত পোষণ করছেন। এই অবস্থায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সংস্থাগুলোর ওপর সচিবেরও নিয়ন্ত্রণ কমছে।


গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়ছে মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ১২টি সংস্থার ওপরও। সংস্থাগুলোর কাজে স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে। গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীর বদলির ক্ষমতা কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে টানাপোড়ন বেড়েছে। সম্প্রতি এই ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের হাতে নিতে প্রস্তাব দেন সচিব। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী সেই প্রস্তাব নাকচ করে আগের মতোই এই বদলির ক্ষমতা প্রধান প্রকৌশলীর হাতে রাখার পক্ষে মত দেন নথিতে। এই অবস্থায় দীর্ঘ সময় পেরোলেও সচিব নথি ছাড়েননি।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী মো. শরীফ আহমেদ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। কাজী ওয়াছি উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রীকে এ বিষয়ে বোঝানো হবে। যদি সুফল না পাওয়া যায়, তাহলে সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। তিনি যা সিদ্ধান্ত দেন, তা-ই হবে।’

জানা যায়, কাজী ওয়াছি উদ্দিন ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর অতিরিক্ত সচিব হিসেবে যোগ দেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে। ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একই মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে তিনি নিয়োগ পান। এরপরই তিনি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে নানা বিষয়ে বিরোধে জড়াতে থাকেন। গোপালগঞ্জের বাসিন্দা কাজী ওয়াছি উদ্দিনের নিয়মিত চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ায় গত ১০ মার্চ তাঁকে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর তিনি প্রতিমন্ত্রীকে না জানিয়ে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেন বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়।

সূত্রমতে, মাসখানেক আগে দুই অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব বণ্টনসংক্রান্ত অফিস আদেশ জারি করা হয় প্রতিমন্ত্রীকে না জানিয়ে। এ ছাড়া প্রতিমন্ত্রী ঈদুল ফিতরের আগে জরুরি প্রয়োজনে প্রধান প্রকৌশলীকে খোঁজ করছিলেন। তাঁকে না পেয়ে কোনো এক মাধ্যমে জানতে পারেন, প্রধান প্রকৌশলী মো. শামিম আখতার দীর্ঘ ছুটি নিয়েছেন সচিবের কাছ থেকে। রাজউক সম্প্রতি পূর্বাচলে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিমালিকদের মাঝে প্লট হস্তান্তরের একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তাতে প্রধান অতিথি করা হয় সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকিকে। এ বিষয়ে রাজউকের পক্ষ থেকে প্রতিমন্ত্রীকে কিছু জানানো হয়নি।

প্রতিমন্ত্রী গত সোমবার এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে ব্যাখ্যা চাইলে তিনি জানান, সচিবের সঙ্গে আলোচনা করে অনুষ্ঠান করা হয়েছে। এরপর প্রতিমন্ত্রী এ বিষয়ে সচিবের কাছে জানতে চান।

এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী মো. শরীফ আহমেদ কিছু বলতে রাজি হননি। রাজউক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এটি আসলে মূল অনুষ্ঠান ছিল না। আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আমাদের প্রতিমন্ত্রী মহোদয় এ-সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে ছিলেন। তাই এবার এভাবেই করা হয়েছে।’

মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রে জানা যায়, সচিব এবার পবিত্র হজ করতে সৌদি আরবে থাকাকালে ঢাকায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীর তিনটি পদে পরিবর্তন আনা হয়। তখন সচিবের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব মো. অলিউল্লাহকে দিয়ে প্রতিমন্ত্রী কাজটি করিয়ে নেন।

অতিরিক্ত সচিব মো. অলিউল্লাহ অবশ্য আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নথি দেখেন, ওখানে আমার কোনো সই নেই।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের লিখিত নির্দেশে প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতারের নানা অনিয়ম নিয়ে তদন্ত চলছে। কিন্তু প্রধান প্রকৌশলীর পক্ষ নিয়ে প্রতিমন্ত্রী তদন্তকাজে প্রভাব খাটাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।

 ফলে চার মাসের বেশি সময়েও তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েনি। মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের কিছু ‘পকেট প্রকৌশলী’ ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ পদ আঁকড়ে আছেন। এ নিয়ে কয়েক বছর ধরে প্রতিমন্ত্রী, সচিব ও প্রধান প্রকৌশলীর মধ্যে বিরোধ চলছে। এ ছাড়া প্রতিমন্ত্রী গত এক মাসে ৫-৬ দিন দপ্তরে বসেছেন অল্প সময়ের জন্য। সেই সুযোগে সচিব কর্তৃত্ব বাড়িয়ে নিয়েছেন। তাতে কাজের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে।

জানা যায়, রাজউক, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ বড় আকারের প্রকল্প নিয়ে কাজ করে। কিন্তু দু-তিন বছর ধরে সংস্থাগুলোর হাতে তেমন কোনো প্রকল্প নেই। একাধিক সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের আগ্রহের ভিত্তিতেই প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়। কিন্তু বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের বিরোধের কারণে কোনো সংস্থা নতুন প্রকল্প হাতে নিতে আগ্রহ দেখায় না।

একজন মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এমনিতেই মন্ত্রীরা দিন দিন মন্ত্রণালয়ে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন। সচিবের সঙ্গে মিলে একই ক্যাডারের কর্মকর্তারা মন্ত্রীর কাজে অসহযোগিতা করেন। ফলে অনেক মন্ত্রী অকার্যকর হয়ে পড়েন। কিন্তু সরকারপ্রধানকেও কিছু জানান না। কারণ, সেখানেও আমলাদের পক্ষে কথা বলার মতো লোক থাকেন।’

সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের সিইও। সেখানে সচিবের তো জানা উচিত, মন্ত্রীর সঙ্গে কীভাবে কাজ করবেন।প্রতিমন্ত্রীকে না জানিয়ে অতিরিক্ত সচিবের দপ্তর বদল বা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হয়নি। আমি মনে করি, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিধি মেনে কাজ করা উচিত। কারণ, শীর্ষ পর্যায়ে সমন্বয় না থাকলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তথা জনগণ ভোগান্তিতে পড়বে।’


শেয়ার করুন