বেশ কদিন ধরেই বাজারে ডিমের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে। যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই ডজনপ্রতি ডিমের দাম বাড়ানো হয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, উৎপাদক থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে সিন্ডিকেট করে বাড়ানো হচ্ছে এই দাম।
বাজার নিয়ন্ত্রণে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের হুঁশিয়ারি, বাজার পর্যায়ে অভিযান ও জরিমানা করেও দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে ভোক্তার যখন ত্রাহি অবস্থা, তখন এর দ্রুত কার্যকর সুরাহায় না গিয়ে বরং সরকারের দায়িত্বশীল দুই মন্ত্রী দিলেন দুই ধরনের অভিমত।
এ বিষয়ে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানালেন ডিম আমদানির কথা। গতকাল রোববার একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে না এলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে।
অন্যদিকে দেশে ডিমের যে উৎপাদন, সে অনুযায়ী বাজার ব্যবস্থা বিন্যাস করলে ডিম আমদানির প্রয়োজন হবে না বলে দাবি করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তিনি আরও দাবি করেন, একটি ডিমের উৎপাদন মূল্য সাড়ে ১০ টাকার মতো হয়। ফলে একটি ডিমের বিক্রয় মূল্য ১২ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।
ভোক্তারা মনে করছেন, ডিম নিয়ে দুই মন্ত্রীর বক্তব্য ও অবস্থান সম্পূর্ণ ভোক্তা স্বার্থবিরোধী। তারা এর মধ্য দিয়ে মূলত বাজার পরিস্থিতিকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিলেন। এ ধরনের মন্তব্য করপোরেট ও বাজার সিন্ডিকেটের অনৈতিক মুনাফাকে এক রকম বৈধতা দেওয়া হলো।
দেশব্যাপী এক কোটি ‘ফ্যামিলি কার্ডধারী’ নিম্ন আয়ের পরিবারের মধ্যে আগস্ট মাসে চালসহ টিসিবির পণ্য সাশ্রয়ী মূল্যে বিক্রয় কার্যক্রমের উদ্বোধন করছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হলে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবি এর আয়োজন করে।
অন্যদিকে ডিমের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এদিন (রোববার) সচিবালয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী।
টিসিবি আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চাইলেই ডিম আমদানি করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ইমপোর্ট পারমিশন লাগবে। তাদের সহযোগিতা ছাড়া ডিম আমদানির সুযোগ নেই। আমি আশা করব, শিগগির এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গ্রিন সিগন্যাল দিলেই ডিম আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রীর এ বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী বলেন, ডিম আমদানি করা না করার বিষয়টি আমরা অন্যভাবে বিবেচনা করব। এই বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইন্ডিপেন্ডেন্টলি বিবেচনা করবে কি করবে না, এটি তাদের বিষয়। আমার কাছে মনে হয়েছে, দেশে যে উৎপাদন আছে, আমরা যদি বাজার ব্যবস্থা বিন্যাস করতে পারি, তবে আমদানির কোনো প্রয়োজন হবে বলে আমার মনে হয় না।
টিপু মুনশি জানান, বাজারে ডিমের দাম কত হবে তা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করে দিলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
সাংবাদিকরা এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এর জবাবে তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সার্ভে অনুযায়ী, একটি ডিম উৎপাদনে সাড়ে ১০ টাকার ওপর খরচ পড়ে। তারপর অন্যান্য ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কিছু লাভের বিষয় থাকে। আমার কাছে মনে হয়েছে, একটি ডিমের দাম ১২ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। এই ১২ টাকা নির্ধারিত হলে যারা উৎপাদনকারী তাদের লাভ হবে। এ সময় তিনি আরও বলেন, আমরা আশা করি, দাম ১২ টাকার মধ্যে রেখে তারা ডিম বিপণনের ব্যবস্থা করবেন।’
আজকের বাজারে (রোববার) ডিমের ডজন ১৭০ টাকা, এই দায় আসলে কার—জানতে চাইলে শ ম রেজাউল করিম মন্ত্রী বলেন, অংশীজনের সঙ্গে বসে আমাদের সার্ভে অনুযায়ী দেখিয়েছি, সাড়ে ১০ টাকা উৎপাদন খরচ হলে ১২ টাকায় বিক্রি হলে তারা প্রচুর লাভ করতে পারবে। বিষয়টি আমরা উৎপাদনকারীদের বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। অনুরোধও করেছি। এর পরও যদি কেউ জনদুর্ভোগ ডেকে নিয়ে আসেন, তা দেখভাল করার জন্য ভোক্তা অধিকার আইন আছে। ভোক্তাদের অধিকার দেখার জন্য কর্তৃপক্ষ আছে। তারা প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেবে।
আর এর উত্তরে টিপু মুনশি জানান, ডিমের বাজার হঠাৎ অস্থিতিশীল হওয়ায় ভোক্তা অধিকার রাতে দিনে রাজধানীর বিভিন্ন আড়তে অভিযান চালাচ্ছে এবং জরিমানা করছে।
মন্ত্রণালয় দাম নির্ধারণ করে দেবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে রেজাউল করিম বলেন, এটা দাম নির্ধারণ করার বিষয় নয়। এর আগে ২০১০ সালে ছোট বাচ্চা মুরগি ও অন্যান্য বিষয়ের দাম নির্ধারণের বিষয় উঠেছিল। সেক্ষেত্রে আদালত প্রশ্ন তুলেছিলেন, মন্ত্রণালয় এভাবে দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে না।
এদিকে টিসিবির অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে টিপু মুনশি জানান, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চিনি আমদানি করা ছাড়াও স্থানীয় বাজার থেকে ক্রয় করা হয়। কারণ, অনেক সময় চিনি দেশে এসে পৌঁছাতে দেরি হয়। আবার জাহাজ বন্দরে আসলে নানা জটিলতায় খালাসে সময় লাগে। এতে করে চাহিদার জোগান দিতে বেগ পেতে হয়। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাজারের পাশাপাশি স্থানীয় বাজার থেকে চিনি ক্রয় করা হয়ে থাকে। ভারত থেকে কোটায় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, চলতি মাসেই তিনি ভারত সফরে যাবেন এবং সে দেশের বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন, তখন এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত জানানো হবে।