ভ্যাট আদায় করার যন্ত্র ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) সরকারিভাবে বসানোর কাজে ব্যর্থতার পর কাজটির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেনেক্স ইনফোসিসকে। প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট আদায় করতে আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে মাঠে নামবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৫০০ ইএফডি দিয়ে এই কার্যক্রম উদ্বোধন করা হবে। তবে যে প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেই জেনেক্স ইনফোসিসই আগে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। ধরা পড়ার পর প্রতিষ্ঠানটি সেই টাকা পরিশোধ করেছে।
নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত অনুসন্ধানে জেনেক্স ইনফোসিসের বিরুদ্ধে ১২ লাখ ২০ হাজার টাকা উৎসে ভ্যাট ফাঁকি ধরা পড়ে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকেও কোনো আপত্তি না জানিয়ে ভুল স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে দাবি করা অর্থ পরিশোধ করেছে জেনেক্স ইনফোসিস।
ভ্যাট ফাঁকির তথ্য উঠে আসায় সেই প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ভ্যাট আদায় কাজে স্বচ্ছতা থাকবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যার বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ প্রমাণিত, তার কাছ থেকে স্বচ্ছতা কিংবা ভালো কিছু আশা করা যায় না, এটা সহজেই বোধগম্য। দায়িত্বটি এনবিআর কীভাবে দিয়েছে, এটা আমরা বলতে পারব না। যদি ওপেন টেন্ডার করে না দিয়ে থাকে তাহলে স্বচ্ছতার প্রশ্ন উঠবেই।’
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, চুক্তির প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতি বা যেকোনো ধরনের প্রীতি ছিল। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মনে হচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদের কাজটা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে কোনো উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার সুযোগ ছিল না। এসব ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি হতে পারে, অথবা যেকোনো ধরনের প্রীতিই হতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা কতটা আমলে নেওয়া হয়েছে, তারা কাজটা করতে পারবে কি পারবে না; সেই ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না। সেই আস্থা-ভরসাটা আসছে না।’
তবে এনবিআর কর্মকর্তাদের দাবি, প্রক্রিয়ায় কোনো ত্রুটি ছিল না। এনবিআরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, সঠিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করেই জেনেক্স ইনফোসিসের সঙ্গে চুক্তি করেছে এনবিআর। সেখানে যাচাই-বাছাইয়ে কোনো ত্রুটি হয়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির ভ্যাট ফাঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি জানি না। বিষয়টি আমার দেখে বলতে হবে। যদিও কোনো প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত করার আগে প্রতিষ্ঠানটি আয়কর, ভ্যাট, শুল্ক খেলাপি কি না, তা যাচাই করা হয়।’
চুক্তি অনুযায়ী, জেনেক্স নিজের টাকায় ইএফডি বসিয়ে কমিশনের ভিত্তিতে সরকারকে ভ্যাট আদায় করে দেবে।
এ জন্য প্রতিষ্ঠানটি প্রতি ১০০ টাকা ভ্যাট আদায় করে ঢাকায় ৫২ এবং চট্টগ্রামে ৫৩ পয়সা কমিশন পাবে। সফটওয়্যার তৈরি, নজরদারি, প্রশিক্ষণসহ প্রচারও চালাবে জেনেক্স।
ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া প্রতিষ্ঠানের হাতে এই দায়িত্ব দেওয়ায় হুমকি তৈরি করবে কি না, জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেন, নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে এনবিআরের সেন্ট্রাল সার্ভারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় দোকানের বিক্রির তথ্য সংরক্ষিত থাকবে এনবিআরের সার্ভারে। ইচ্ছা করলে কেউ এর তথ্য মুছে ফেলতে পারবে না। আর বিদ্যুৎ বা নেটওয়ার্ক না থাকলেও এ মেশিন অফলাইনে তথ্যাদি নিজস্ব মেমোরিতে ধারণ করবে। পরবর্তী সময়ে বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্ক ফিরে এলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেন্ট্রাল সার্ভারের সঙ্গে সমন্বয় হয়ে যাবে। ওই কর্মকর্তাদের দাবি, জেনেক্স ইনফোসিস লেনদেনের তথ্যে কারসাজি করতে পারবে না।
জেনেক্স সূত্রে জানা যায়, প্রায় ২০ হাজার ইএফডির এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ৫ হাজার হাতে এসে পৌঁছেছে। বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন।
এনবিআরের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ৯ হাজার ৪৪৯টি ইএফডি স্থাপন করা হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মূসক নিবন্ধনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪ লাখ ৩২ হাজার ৯৫৫। চলতি বছর ৬০ হাজার মেশিন বসানোর লক্ষ্য আছে। তবে শুরুর আগেই এর সফলতা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, আগে ব্যবসায়ী ও এনবিআর ইএফডি বসানো নিয়েই যে সময়ক্ষেপণ করেছে, তাতে সমাধান গেছে তৃতীয় পক্ষের হাতে। তারাই মেশিন কিনবে, বসাবে। এখানে তাদের যদি কোনো দোষ থাকে, ফেল করে বা কিছু এড়িয়ে যায়, সেটা কর্তৃপক্ষ দেখবে। তিনি আরও বলেন, ২০১২ সাল থেকেই এই মেশিন বসানো নিয়ে নানা জটিলতা হয়েছে এবং এতে ব্যবসায়ীরাই লাভবান হয়েছেন।