প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসাবে খ্যাত সিলেটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নয়নাভিরাম স্থানগুলোর অধিকাংশ যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না থাকার কারণে পর্যটকদের অদেখা থেকে যায়। ভ্রমণপিপাসুরা যাতে মাত্র দুই দিনে ২৩টি স্পট ঘুরে দেখতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করতেই জেলা প্রশাসক সম্মেলনে সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলং থেকে কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষে ৩০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। প্রস্তাবনায় ছিল সীমান্ত এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান ও পর্যটনশিল্পে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সম্ভাবনার বিষয়টি। প্রস্তাবনা শুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। নির্দেশনা অনুযায়ী ইতোমধ্যে প্রাথমিক জরিপ সম্পন্ন করেছে সিলেট সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
জানা যায়, সিলেটে ঘুরতে আসা পর্যটকরা জাফলং ও ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে একদিনে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এছাড়া সীমান্তঘেঁষা পথে যেখানে ৩০ কিলোমিটার পাড়ি দিলেই সাদাপাথর পৌঁছা যায়, সেখানে প্রায় ১২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে শুধু জাফলং আর সাদাপাথরই উপভোগ করতে পারেন তারা। যোগাযোগব্যবস্থা না থাকার কারণে ভারত সীমান্তঘেঁষা অধিকাংশ স্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন পর্যটকরা।
সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও জাফলং আর সাদাপাথরের মধ্যবর্তী প্রায় ৫টি স্পটে পর্যটকদের আনাগোনা নেই বললেই চলে। এছাড়া পাথরকোয়ারি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সীমান্তবর্তী প্রায় ২৫টি গ্রামের মানুষ এখন বেকার। কাজের খুঁজে অবৈধভাবে ভারতে পাড়ি দিয়ে প্রাণ যাচ্ছে অনেকের। বেশির ভাগ মানুষ ঝুঁকি নিয়ে চোরাকারবারিতে জড়িয়ে পড়ছেন। বিষয়গুলো মাথায় রেখেই গত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে জাফলং থেকে ভোলাগঞ্জ পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের প্রস্তাবনাটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে তুলে ধরেন তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার। ২৪ এপ্রিল দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দিয়ে পত্র পাঠানো হয়। ইতোমধ্যে প্রাথমিক জরিপের কাজ শেষ করেছে সওজ। সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ইতোমধ্যে তারা প্রাথমিক জরিপ কাজ শেষ করেছেন। রাস্তা নির্মাণের কাজটি কোন বিভাগ করবে, তা সরকার নির্ধারণ করবে। এই প্রকল্পটির আশপাশে আরও কয়েকটি চলমান প্রকল্প থাকায় এই সড়ক নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। তবে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি কোন প্রতিষ্ঠান কাজটি করবে।
এ বিষয়ে এই প্রস্তাবনার কারিগর গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিলুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সীমান্ত এলাকার হাজারো মানুষের উন্নয়ন বাদ দিয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। পাথর উত্তোলন বন্ধ হওয়ায় পর্যটনই হতে পারে সীমান্তবর্তী মানুষের কর্মসংস্থান। এছাড়া অসম্ভব সুন্দর স্পটগুলো যাতে পর্যটকরা দেখতে পারেন, সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই এই প্রস্তাবনাটি দেওয়া হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, মাত্র ৩০ কিলোমিটারের রাস্তা এ অঞ্চলের পর্যটনশিল্পকে আমূল বদলে দেবে। এই সড়ক ঘিরে সবুজ পাহাড়ের নিচে গড়ে উঠবে হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট। সেই সঙ্গে সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলোয় ইকো ট্যুরিজমের সুযোগ তৈরি হবে।
এমন খবরে সাধুবাদ জানিয়েছেন সিলেটের ব্যবসায়ী নেতারা। সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি তাহমিন আহমেদ বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বিনিয়োগের অভাব হবে না। দেশীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটে পর্যটন খাতে বিদেশি বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। দ্রুত এই সড়কটি বাস্তবায়নের দাবি জানান তিনি।
সড়কটি বাস্তবায়ন হলে প্রস্তাবিত ট্যুর প্ল্যান অনুযায়ী সিলেটে থেকে জাফলংয়ের উদ্দেশে প্রথম দিনে পর্যটকরা ডিবির হাওড়, জৈন্তাপুর রাজবাড়ী, নলজুরি ওয়াটার ফলস ভিউপয়েন্ট, শ্রীপুর জিরো পয়েন্ট, রাংপানি নদী, তামাবিল জিরো পয়েন্ট, জাফলং জিরো পয়েন্ট ঘুরতে পারবেন। জাফলংয়ের ডাউকি নদীর ওপর কেবল কারের প্রস্তাবনা রয়েছে। পর্যটকরা চাইলে কেবল কারে নদী পার হতে পারবেন আবার জাফলং ব্রিজ দিয়েও গাড়ি নিয়ে নদী পার হয়ে খাসিয়া পুঞ্জি, চা বাগান ঘুরে ভারতীয় পাহাড়ের পাশ দিয়ে প্রস্তাবিত সড়ক ধরে মায়াবি ঝরনা, পান্থুমাই ঝরনা, বিছনাকান্দি ট্যুরিস্ট স্পট দেখতে পারবেন। উপজেলা প্রশাসন থেকে পাঠানো প্রস্তাবনায় বিছনাকান্দিতে (গোয়াইনঘাট উপজেলায়) পর্যটকদের রাত্রিযাপনের জন্য হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট তৈরি হবে। এ খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাশা করা হয়েছে।
প্রস্তাবনায় দ্বিতীয় দিন ভোর থেকে ভ্রমণপিপাসুরা লক্ষণছড়া, উতমাছড়া, সাদাপাথর ট্যুরিস্ট স্পট ঘুরে আবারও সিলেটে ফিরতে পারবেন। ফেরার পথে রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট, বাইশটিলায় নৌকা ভ্রমণ, মালনিছড়া চা বাগান, লাক্কাতুরা চা বাগান, সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম, খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান, হজরত শাহপরান (রহ.) মাজার, সিলেটের প্রথম মুসলিম গাজী বুরহান উদ্দিন (রহ.) মাজার, হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজার দর্শন ও জিয়ারতের মধ্য দিয়ে শেষ করতে পারবেন দ্বিতীয় দিনের ভ্রমণ। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, পর্যটকরা ইচ্ছা করলে উলটোদিক থেকেও শুরু করতে পারবেন তাদের ভ্রমণ। সেক্ষেত্রেও গোয়াইনঘাট অংশে রাত্রিযাপন করতে পারবেন।