দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত না হলে ভোটে অংশগ্রহণ করবে না বলে ঘোষণা রয়েছে বিএনপির। একই অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্য বিরোধী দলগুলোও। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কীভাবে অংশগ্রহণমূলক করা যায়, সেই কৌশল আঁটছে ক্ষমতাসীনেরা। শুরু হয়েছে বিএনপি থেকে বেরিয়ে যাওয়া কিছু পরিচিত মুখকে সামনে রেখে নতুন জোট গঠনের প্রক্রিয়া। এর অংশ হিসেবে মাঠে নেমেছে বিএনপির প্রয়াত নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার গঠন করা দল তৃণমূল বিএনপি।
গতকাল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছে তৃণমূল বিএনপির কাউন্সিল। এই কাউন্সিলে দলটির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সমশের মবিন চৌধুরী বীর বিক্রম। আর মহাসচিব করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি তৈমূর আলম খন্দকারকে।
সমশের মবিন চৌধুরী কর্মজীবনের শুরুতে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গুরুতর আহত হওয়ায় স্বাধীনতার পর তাঁর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। তিনি পরবর্তী সময়ে পররাষ্ট্রসচিব ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর যোগ দেন বিএনপিতে, হন দলটির ভাইস চেয়ারম্যানও। তবে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিকে ঘিরে হতাশা ও অভিমান থেকে ২০১৫ সালের অক্টোবরে দলটি থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া সমশের মবিন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আবার নতুন দলের নেতৃত্ব নিলেন।
গতকাল তৃণমূল বিএনপির কাউন্সিলে দেওয়া বক্তব্যে সমশের স্মরণ করেন আওয়ামী লীগের দুই প্রয়াত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে।
তৃণমূল বিএনপিকে একটি ‘স্বাধীন রাজনৈতিক দল’ হিসেবে দাবি করে সমশের বলেন, ‘এই দলের চিন্তাভাবনা নিজেদের। এটি ‘‘কিংস পার্টি’’ নয়। এটি জনগণের পার্টি। কিংস পার্টি গঠিত হয়েছিল (২০০৭ সালের) এক-এগারোর সময়।’
সমশের বলেন, তাঁর দল অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। সেটা সম্ভব যদি প্রশাসন নিরপেক্ষ ও পেশাদার ভূমিকা পালন করে, নির্বাচন কমিশন যদি তার ক্ষমতার প্রয়োগ সঠিকভাবে করতে পারে।
ভোট যদি সঠিকভাবে গণনা হয়, তাহলে আগামী সংসদ নির্বাচনে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা হবে বলেও মনে করেন তিনি।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে গতকাল দুপুর প্রায় ১২টায় জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করে শুরু হয় তৃণমূলের কাউন্সিল। শুরুতে বক্তব্য দেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা বিএনপির একসময়ের মহাসচিব এবং ২০০১-২০০৬ সালে খালেদা জিয়া সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার মেয়ে অন্তরা সেলিমা হুদা। অন্তরা নতুন নিবন্ধন পাওয়া দলে গতকাল এক্সিকিউটিভ চেয়ারপারসন হয়েছেন।
গতকাল ২৭ সদস্যের যে আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়, তাতে মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি তৈমূর আলম খন্দকার। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচনে দলের নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে মেয়র প্রার্থী হলে বিএনপি তাঁকে বহিষ্কার করে।
তৈমূর আলম বলেন, তিনি মনে করেন, বিএনপির সঙ্গে আদর্শগত মিল রয়েছে তৃণমূল বিএনপির। নতুন দল ‘প্রাইভেট কোম্পানির হবে না’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সুস্থতা ও মুক্ত জীবন কামনা করেন এই রাজনীতিক।
তৃণমূলের পুনর্গঠনের পুরো প্রক্রিয়াকে নির্বাচনের আগে উদ্দেশ্যমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ। তিনি বলেন, নির্বাচনের একটা কৌশল হিসেবে এই দলের উত্থান।
দলটির কোনো আদর্শ ও জাতীয় পর্যায়ে সাংগঠনিক ভিত্তি নেই, এমন পর্যবেক্ষণ দিয়ে সাব্বির আহমেদ বলেন, এই দলে যাঁরা যুক্ত হয়েছেন, তাঁদের মূল উদ্দেশ্য হলো ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা।
বিএনপি কী বলছে
তৃণমূল বিএনপি ও নির্বাচন সামনে রেখে নানামুখী তৎপরতার প্রতি ইঙ্গিত করে গতকাল টঙ্গীতে বিএনপির সমাবেশে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘কিছু ফেরিওয়ালা আছে, বিভিন্ন সংস্থার লোকজন আছে। তারা ফেরি করে লোকজন জড়ো করছে। ভবিষ্যতে তারা আরেকটা নাটক করবে। আরেকটা নাটকের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করবে। তার একটা লক্ষণ, আজ একটা পার্টি হয়েছে…রাজনীতিবিদ কেনাবেচার হাট শুরু হয়ে গেছে।’
শেখ হাসিনার পাতানো নির্বাচনে যারাই পা বাড়াবে, তাদের পা আস্ত থাকবে না বলে উল্লেখ করে গয়েশ্বর বলেন, জনগণ তাদের পা ভেঙে দেবে।
কাউন্সিলের অতিথি যাঁরা
তৃণমূল বিএনপির গতকালের কাউন্সিলে বিএনপির বর্তমান কোনো সুপরিচিত নেতাকে দেখা যায়নি। তবে বর্তমান সরকার ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলে এমন ২০টি নিবন্ধনহীন রাজনৈতিক দলের নেতারা শুভেচ্ছা জানাতে আসেন অনুষ্ঠানে। কয়েকজন নেতা তৃণমূল বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগ্রহের কথাও জানান।
সংগঠনগুলোর নেতাদের মধ্যে বক্তৃতা করেন বিএলডিপির চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দীন আল আজাদ, যিনি ১৯৭৯ সালে বিএনপি থেকে এমপি নির্বাচিত হন। পরে তিনি সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের সরকারে যোগ দিয়ে ধর্মমন্ত্রী হন। এরপর ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন।
এর বাইরে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ প্রগতিশীল ইসলামী জোটের চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়াল, জাতীয় স্বাধীনতা পার্টির চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশ, প্রগতিশীল ন্যাপের আহ্বায়ক পরশ ভাসানী ও গণ আজাদী লীগ, সনাতন পার্টি, হিউম্যানিস্ট পার্টি, মানবাধিকার আন্দোলন, ইসলামী গণতান্ত্রিক লীগ, জনতা ফ্রন্ট, ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক পার্টি ও জাতীয় মুক্তি দলের নেতারাও অতিথি হিসেবে তৃণমূলের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
আংশিক কমিটি ঘোষণা
তৃণমূল বিএনপির সদ্য ঘোষিত আংশিক কমিটিতে দলের কো-চেয়ারপারসন হয়েছেন কে এ জাহাঙ্গীর মাজমাদার। ভাইস চেয়ারপারসন হয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর ডা. হাবিবুর রহমান, মোখলেছুর রহমান, দিপক কুমার পালিত, মেনোয়াল সরকার ও ছালাম মাহমুদ। এ ছাড়া মো. আক্কাস আলী খান, যুগ্ম মহাসচিব রেজাউল করিম, মাছুদুর রহমান, ফয়েজ চৌধুরী, তালুকদার জহিরুল হক ও রোকসানা আমিন সুরমাকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এবং মো. শামীম আহসানকে কোষাধ্যক্ষ করা হয়েছে। সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছেন শাহজাহান সিরাজ, আকবর খান ও কামাল মোড়ল। দপ্তর সম্পাদক এ কে সাইদুর রহমান ও মোহাম্মদ রাজু মিয়া। অন্যদের মধ্যে ইব্রাহীম খলিল সবুজ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক, শাহাব উদ্দীন ইকবাল যুববিষয়ক সম্পাদক, অ্যাডভোকেট আশানুর রহমান আইনবিষয়ক সম্পাদক, স্থপতি নাজমুন সাকিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক, সাগর ঘোষ প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং ফরহাদ হোসেন স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক হয়েছেন। তাঁরা সবাই সংগঠনের আগের কমিটিতে ছিলেন।