জমি ও ফ্ল্যাটের নিবন্ধন পদ্ধতি আমূল বদলে যাচ্ছে। নানা সমালোচনা ও বিতর্কের মুখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) উচ্চ নিবন্ধন কর আরোপের অবস্থান থেকে সরে আসছে। একই সঙ্গে ঘোষিত এলাকাভিত্তিক কর আরোপের পরিবর্তে মৌজাভিত্তিক কর ধার্য করা হচ্ছে। ফলে জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনে বাড়তি করের বোঝা কমছে ভোক্তার।
এনবিআর জমি ও ফ্ল্যাটের নিবন্ধন কৌশল ও কর কমানোর প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। শিগগির তা অনুমোদন হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। অনুমোদনের পর তা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হবে।
সূত্র বলেছে, চলতি বাজেটে জমি ও ফ্ল্যাটের নিবন্ধন কর দ্বিগুণ করে সরকার। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয় এবং এই খাতে রাজস্ব আদায়ে ধস নামে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এনবিআর উৎসে কর আদায়ের পদ্ধতি বদলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিদ্যমান এলাকাভিত্তিক উৎসে কর হারের পরিবর্তে মৌজা ও শ্রেণিভিত্তিক (আবাসিক, বাণিজ্যিক, রিয়েল এস্টেট বা ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নকৃত জমি) কর আদায় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নতুন পদ্ধতিতে জমির পাঁচটি শ্রেণি করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে—ক শ্রেণি: রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত অধিদপ্তর এবং ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন বাণিজ্যিক এলাকা (জমি বা প্লট)। খ শ্রেণি: ক শ্রেণিতে উল্লেখিত এলাকার আবাসিক। গ শ্রেণি: রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত অধিদপ্তর এবং ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়, কিন্তু ডেভেলপার বা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যিক এলাকা। ঘ শ্রেণি: গ শ্রেণিতে উল্লেখিত আবাসিক এলাকা। ঙ শ্রেণি: ক, খ, গ, ঘ শ্রেণি ব্যতীত অন্য সব এলাকা; দেশের পৌরসভা ও প্রত্যন্ত এলাকার জমি বা প্লট।
এ ছাড়া মৌজাভিত্তিক পৃথক উৎসে কর হার নির্ধারণ করা হচ্ছে। ঢাকার গুলশান, বনানী, মতিঝিল ও তেজগাঁও থানার সব মৌজার জমি কেনাবেচায় শ্রেণিভিত্তিক হারে উৎসে কর দিতে হবে। ধানমন্ডি, ওয়ারী, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা, শাহবাগ, রমনা, পল্টন, বংশাল, নিউমার্কেট ও কলাবাগান থানা। খিলক্ষেত, কাফরুল, মোহাম্মদপুর, সূত্রাপুর, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা মডেল থানা, ক্যান্টনমেন্ট থানা, চকবাজার, কোতোয়ালি, লালবাগ, খিলগাঁও, শ্যামপুর, গেন্ডারিয়া থানার সব মৌজা। বিমানবন্দর, উত্তর-পশ্চিম মুগদা, রূপনগর, ভাষানটেক, বাড্ডা, পল্লবী, ভাটারা, শাহজাহানপুর, মিরপুর মডেল থানা, দারুস সালাম, দক্ষিণখান, উত্তরখান, তুরাগ, শাহ আলী, সবুজবাগ, কদমতলী, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, ডেমরা ও আদাবর থানা, গাজীপুরের জয়দেবপুর ও কালীগঞ্জ থানার সব মৌজা, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁও থানার সব মৌজা।
চট্টগ্রামের খুলশী, পাঁচলাইশ, পাহাড়তলী, হালিশহর ও কোতোয়ালি থানার সব মৌজা, নারায়ণগঞ্জ জেলা সদর, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর থানার সব মৌজা, গাজীপুর জেলার সদর, বাসন, কোনাবাড়ি, গাছা, টঙ্গী পূর্ব, টঙ্গী পশ্চিম থানার সব মৌজা। ঢাকা জেলার দোহার, নবাবগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, সাভার, ধামরাই উপজেলার সব মৌজা, চট্টগ্রামের আকবর শাহ, ইপিজেড, কর্ণফুলী, চকবাজার, চান্দগাঁও, ডবলমুরিং, পতেঙ্গা, পাঁচলাইশ, বন্দর, বাকলিয়া, বায়েজিদ বোস্তামি ও সদরঘাট থানার সব মৌজা এবং নারায়ণঞ্জের আড়াইহাজার থানার সব মৌজা।
এ ছাড়া জেলা সদরে অবস্থিত পৌরসভার অন্তর্গত সব মৌজা, জেলা সদরের বাইরে পৌরসভা এলাকার অন্তর্গত মৌজা এবং পৌরসভা ব্যতীত অন্য সব এলাকার জন্য পৃথক উৎসে কর হার নির্ধারণ করা হচ্ছে। একইভাবে ফ্ল্যাট নিবন্ধনের ক্ষেত্রে মৌজা ও শ্রেণিভিত্তিক বর্গমিটারপ্রতি উৎসে কর নির্ধারণ করা হচ্ছে। এতে করে বিদ্যমান উৎসে কর আগের চেয়ে কমে আসবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, জমি নিবন্ধনের (রেজিস্ট্রেশন) সময় দলিলে লিখিত মূল্যের ১ শতাংশ রেজিস্ট্রেশন ফি, ১ দশমিক ৫০ শতাংশ স্ট্যাম্প শুল্ক, এলাকাভেদে স্থানীয় সরকার কর ২-৩ শতাংশ এবং রাজউক (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) ও সিডিএ (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) অন্তর্ভুক্ত এলাকার আয়কর আইনের তফসিল অনুযায়ী উৎসে কর দিতে হয়। পুরোনো আয়কর আইনে, এলাকাভিত্তিক দলিলমূল্যের ওপর ৪ শতাংশ হারে উৎসে কর অথবা কাঠাপ্রতি ছিল। গত জুনে এটি বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়। এতে জমি-ফ্ল্যাট নিবন্ধন অনেক কমে যাওয়ায় উৎসে কর পুনর্বিন্যাসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জমি কেনাবেচার সময় ক্রেতা উৎসে করসহ যাবতীয় কর পরিশোধ করেন।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অস্বাভাবিকভাবে উৎসে কর বাড়ানোর সময়ই আমরা বলেছিলাম, এটা ঠিক হচ্ছে না।
এতে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তা-ই হয়েছে। জমি নিবন্ধন কমে রাজস্ব আদায় এক-তৃতীয়াংশে নেমেছে। মৌজাভিত্তিক হতে পারে, তবে সেটা যেন বাস্তবভিত্তিক হয়। জমির দামের চেয়ে তিন গুণ বাড়ানো হলে তা বাস্তবভিত্তিক হবে না।’ তিনি বলেন, অবাস্তব কিছু করলে ফলাফল একই রকম হবে।