নির্বাচনের আগে সরকার আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের পথে যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তির দিকে। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে গেলে স্থানীয় বাজারে তেলের দাম কিছুটা হলেও বাড়বে। তাতে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। মানুষ এখনই অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতিতে জর্জরিত। এই অবস্থায় জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আরও বাড়বে। যদিও গত সেপ্টেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে মাসে মাসে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে দাম সমন্বয় করার শর্ত ছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অন্তত পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকার নির্বাচনের আগে আইএমএফের শর্ত মেনে মাসে মাসে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করার পথে যাচ্ছে না। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, এ মুহূর্তে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে জনমনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিপিসি এরই মধ্যে এ বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগে।
সরকার কবে নাগাদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের পথে যাবে জানতে চাইলে বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) খালিদ আহম্মেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখন ওঠানামার মধ্যে আছে। জ্বালানি তেলের দাম আগের চেয়ে বেড়েছে। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে স্থানীয় বাজারে দাম নির্ধারণ করতে গেলে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ার সম্ভাবনা আছে।
আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা অনুমোদন করার আগে যেসব শর্ত দিয়েছিল, তার অন্যতম স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করার ফর্মুলা তৈরি করতেও নির্দেশ দিয়েছিল। সরকার এখন নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জ্বালানির দাম নির্ধারণ করছে। এর আগে সরকার এলপিজি সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণের মতো প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করার ঘোষণা দিয়েছিল। সে অনুযায়ী সরকার চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ হারে বাড়িয়েছিল। তাতে জনগণের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে সরকার সেই প্রক্রিয়া থেকে সরে আসে।
বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, এখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই অবস্থায় জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে নির্ধারণ করতে গেলে স্থানীয় বাজারে ডিজেলের দাম বাড়াতে হবে। ডিজেলের দাম বাড়লে বাসভাড়া থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম আরেক দফা বাড়বে।
সৌদি আরব ও রাশিয়া অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উৎপাদন কমানোর ঘোষণা দেওয়ার পর চড়তে থাকে এর দাম। সৌদি আরব নিজের দেশের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে এবং রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মুখে অর্থনীতি ঠিক রাখতে তেল উৎপাদন কমানোর ঘোষণা দেয় ৫ সেপ্টেম্বর। সেদিনই ইন্টারন্যাশনাল বেঞ্চমার্ক ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৯০ ডলার ছুঁয়ে যায়, যা এ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বেঞ্চমার্ক ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট ক্রুড অয়েলের দাম ঠেকেছে ৮৭ দশমিক ৭৫ ডলারে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর ব্রেন্ট বিক্রি হয়েছে ৯২ দশমিক ২০ ডলারে। অথচ গত ১ জুন ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট ক্রুড অয়েল বিক্রি হয়েছে প্রতি ব্যারেল ৭০ দশমিক ১০ ডলারে।
বিপিসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের পরিকল্পনাটি মাসখানেক আগেও শুরু করা গেলে জ্বালানি তেল ব্যবহারকারীরা একটু কম দামে পেত। এই প্রক্রিয়া এখন শুরু করলে অকটেন, পেট্রল ছাড়া ডিজেলসহ বাকি পণ্যের দাম বাড়ার সম্ভাবনা আছে।
বর্তমানে সরকার প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের খুচরা মূল্য নির্ধারণ করেছে ১০৯ টাকা, পেট্রলের ১২৫ এবং অকটেন ১৩০ টাকা। ২০১৪-২০২১ পর্যন্ত বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন কম ছিল, বিপিসি তখন ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা মুনাফা করে।
প্রতিবেশী ভারতে ১৫ দিন পরপর বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে জ্বালানির দাম নির্ধারণ করা হয়। বিপিসি জানিয়েছে, ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণের সূত্র মেনে বাংলাদেশে সেপ্টেম্বরের প্রথম দিন থেকে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের লক্ষ্য ছিল সরকারের।
ব্যবসায়ীদের কমিশন বাড়ল
ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ডিলার পর্যায়ে জ্বালানি তেলের কমিশন বাড়িয়ে মূল্য সমন্বয় করেছে সরকার। গতকাল মঙ্গলবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এর আগে ২৬ সেপ্টেম্বর ডিলার বা এজেন্ট পর্যায়ে কমিশন নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করে জ্বালানি মন্ত্রণালয়। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে তাঁদের কমিশন বাড়ানো হলেও ভোক্তা পর্যায়ে এর সুফল নেই। জ্বালানি তেলের মূল্য পুনর্নির্ধারণ ও সমন্বয়ের ক্ষেত্রে অবচয়, সব খরচসহ ডিলার বা এজেন্টদের কমিশন এবং ট্যাংকলরির ভাড়াসহ অকটেনে ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ, পেট্রলে ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ, কেরোসিনে ২ শতাংশ, ডিজেলে ২ দশমিক ৮৫ শতাংশ কমিশন নির্ধারণ করে সরকার।
মূল্য সমন্বয়ের আগে ডিলার পর্যায়ে ডিজেলের মূল্য ছিল ৮৮ টাকা ২১ পয়সা, যা বর্তমানে নির্ধারিত হয়েছে ১০১ টাকা ৪৪ পয়সা। কেরোসিনের মূল্য ছিল ৮৮ টাকা ৯৭ পয়সা, যা নির্ধারিত হয়েছে ১০২ টাকা ৩১ পয়সা। এ ছাড়া অকটেনের দাম ১০৪ টাকা ২ পয়সা থেকে ১১৯ টাকা ৬২ পয়সা, পেট্রলের দাম ৯৯ টাকা ৮৮ পয়সা থেকে ১১৪ টাকা ৮৬ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ মূল্য সমন্বয়ের ফলে ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি তেলের দামের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি তেলের দাম যথারীতি আগের মতোই রয়েছে। ভোক্তা পর্যায়ে সর্বশেষ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলেও ডিলার পর্যায়ে সেই হারে কমিশন বাড়ানো হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে পেট্রলপাম্প মালিকেরা দাবি করেন, তাঁরা লোকসানের মুখে পড়ছেন। ডিলার পর্যায়েও তেলের কমিশন বাড়ানোর দাবি তোলেন তাঁরা। গত ৩ সেপ্টেম্বর থেকে তেল উত্তোলন, পরিবহন এবং পেট্রলপাম্পে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল পেট্রল পাম্প মালিক সমিতি।