১৯ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০:২১:১০ পূর্বাহ্ন
‘মরা মানুষের ঢিলে’ পুলিশ আহত, হয়েছে মামলা
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-১০-২০২৩
‘মরা মানুষের ঢিলে’ পুলিশ আহত, হয়েছে মামলা

মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার হাসনাবাদ গ্রামের হাজি রুমুজ আলীর ছেলে লোকমান হোসেন। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গেছেন ৬ বছর ২ মাস আগে। অথচ কবর থেকে তাঁর ছোড়া ঢিলে নাকি আহত হয়েছে পুলিশ।


এ ছাড়া ফ্রান্স থেকে নাঈম উদ্দীন, সৌদি আরব থেকে জায়েদ ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বুরহান উদ্দীনও নাকি পুলিশকে ইট-পাথর মেরেছেন। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ছুটে আসা সেই ঢিলেও পুলিশ আহত হয়েছে অভিযোগ তুলে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। জুড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) খসরুল আলম বাদল গত শুক্রবার এ মামলা করেছেন। বিষয়টি জানাজানি হলে সিলেটজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।


মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. ফরহাদ মিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, এক মৃত ব্যক্তি ও তিন প্রবাসীকে আসামি করার বিষয়টি তাঁর নজরে এসেছে। তদন্তে তাঁদের নাম বাদ দেওয়া হবে।


সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মৌলভীবাজারের সাধারণ সম্পাদক জহর লাল দত্ত বলেন, কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ মামলা করতেই পারে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়ের করা মামলায় মৃত ও প্রবাসীদের নামে মামলা দেওয়া অরাজকতা ছাড়া কিছুই না।


মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত বৃহস্পতিবার জামায়াত-শিবির ও বিএনপির কর্মীরা যান চলাচল বন্ধ ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করার জন্য উত্তেজিত হয়ে মিছিল আকারে জুড়ী সদরে স্টেশন রোডের আলফালাহ ইসলামি একাডেমির সামনে বের হলে পুলিশ যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে মিছিল না করার জন্য অনুরোধ করে। অনুরোধ না মানলে নিষেধ ও সতর্ক করে পুলিশ। তখন নেতা-কর্মীরা পুলিশের আদেশ অমান্য করে সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টি করে। পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্যে ৫০-৬০ জন নেতা-কর্মী আক্রমণ করেন। নেতা-কর্মীদের ইট-পাথরের আঘাতে এসআই মো. সিরাজুল ইসলামের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ও হাঁটুতে এবং কনস্টেবল রুবেল আহমদের মাথায় গুরুতর জখম হন। মামলায় জামায়াত-শিবির ও বিএনপির ২৮ জনের নামোল্লেখসহ আরও ২০-২৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১১ নম্বর আসামি হাসনাবাদ গ্রামের লোকমান হোসেন। তিনি মারা যান ২০১৭ সালের ৪ আগস্ট। তাঁর বড় ভাই মাহতাব মিয়া বলেন, ‘লোকমান ছয় বছর দুই মাস আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এখন ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে কবরস্থান থেকে এসে কীভাবে মিছিল আর মিটিং করল, সেটা একটা প্রশ্ন। জীবিত থাকতেও মিথ্যা মামলায় আমার ভাইকে ছয় মাস জেল খাটানো হয়।’


৬ নম্বর আসামি করা হয়েছে উপজেলার হামিদপুর গ্রামের মৃত ফয়জুল্লাহর ছেলে জায়েদ আহমদকে। তিনি পাঁচ বছর আগে সৌদি আরবে পাড়ি জমান। জায়েদের মা হারিচুন নেছা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সাত-আট বছর আগে থেকে আমার ছেলে বিদেশে। পুলিশ এসে পাসপোর্ট, ভিসাসহ সকল কাগজপত্র নিয়ে গেছে।’


২৩ নম্বর আসামি করা হয়েছে ফুলতলা ইউনিয়নের রজব উদ্দীনের ছেলে বুরহান উদ্দীনকে। তিনি দুই বছর ধরে আরব আমিরাতে আছেন। ২৪ নম্বর আসামি ফুলতলা বাজারের ইব্রাহীম আলীর ছেলে নাঈম উদ্দীন দুই বছর আগে ফ্রান্সে পাড়ি জমান।


ফুলতলা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার ইমতিয়াজ গফুর মারুফ আজকের পত্রিকাকে বুরহান ও নাঈমের বিদেশে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।


এজাহারে আটজনকে সাক্ষী করা হয়েছে। তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মী-সমর্থক। আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে তাঁদের পাঁচজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা ঘটনার ব্যাপারে সুস্পষ্ট-সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারেননি। প্রথম সাক্ষী ইমরুল ইসলাম কানন বলেন, ‘মারামারি দেখিনি, মিছিল দেখেছি। এ সময় তাদের সঙ্গে পাঁচ-সাতটি লাঠি ও ইট-পাটকেল ছিল। গোলাম শাহরিয়ার ভালো বলতে পারবে।’ গোলাম শাহরিয়ার প্রথমে নিজের পরিচয় নিশ্চিত করলেও ঘটনার বিষয় জানতে চাইলে বলেন, ‘মোবাইলটি আমার বন্ধুর। তাঁর কাছে দিচ্ছি বলে ফোন কেটে দেন। এরপর আর তাঁকে ফোনে পাওয়া যায়নি।’ আর সুমন পারভেজ প্রথমে বলেন, ‘মিছিল হয়েছে, মারামারি হয়েছে কি না সঠিক বলতে পারব না।’


উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও জায়ফরনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজি মাছুম রেজা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ঘটনার দিন তাঁদের কোনো কর্মসূচি ছিল না। এই ঘটনার সঙ্গে বিএনপির কোনো নেতা-কর্মীর সম্পৃক্ততা নেই।’


তবে মিছিলে উপস্থিত ছিলেন ও বক্তব্য দেন মৌলভীবাজার জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির আব্দুর রহমান। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে আমরা শান্তিপূর্ণ মিছিল করেছি। নিউমার্কেট থেকে মধ্যবাজারে গিয়ে সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। পুলিশ তখন ছিলই না, মারামারি তো প্রশ্নই ওঠে না। গায়েবি তথ্যে পুলিশের মামলায় সংঘাতের যে স্থান উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে আমাদের মিছিলই হয়নি।’


এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদী জুড়ী থানার এসআই খসরুল আলম বাদল থানার ওসির সঙ্গে কথা বলতে বলেন।


ওসি মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এজাহার করা হয়েছে। তদন্তে মৃত ব্যক্তি ও প্রবাসীদের বাদ দেওয়া হবে।’


মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মো. মনজুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টা আমরা জেনেছি। এজাহারটা হচ্ছে প্রাথমিক তথ্য বিবরণী। পরবর্তীতে তদন্তসাপেক্ষে এটা আমরা সংশোধন করে নিব। কমিটিও করেছি, যদি আমাদের কোনো সদস্যের দোষ থাকে, সেটাও দেখা হবে।’


শেয়ার করুন