শুল্কায়নের ১০ দিনের মধ্যে শুল্ক-কর পরিশোধ সাপেক্ষে পণ্য বন্দর থেকে খালাস নিতে হবে, নইলে গুনতে হবে জরিমানা। কনটেইনার জট কমাতে নতুন কাস্টমস আইনে এ বিধান রাখা হয়েছে। এমনকি বন্দরে পৌঁছানোর ৫ দিনের মধ্যে পণ্যের ঘোষণা বা বিল অব এন্ট্রি জমার বিধান রাখা হয়েছে, এ নিয়ম ভঙ্গ করলে আমদানিকারককে জরিমানা গুনতে হবে। যদিও বিল অব এন্ট্রি সংশোধনের সুযোগ এবং শুল্ক ফাঁকি উদ্ঘাটনের আগে অপরাধ স্বীকার করলে জরিমানা থেকে অব্যাহতির বিধান রাখা হয়েছে আইনে।
৩১ অক্টোবর জাতীয় সংসদে কাস্টমস আইন ২০২৩ পাশ হয়। পুরোনো আইনে ২২৩টি ধারা ছিল। নতুন আইনে ২৬৯টি ধারা আছে। রাজস্ব সংগ্রহ এবং বাণিজ্য সহজীকরণের লক্ষ্যে বিশ্ব কাস্টমস সংস্থার (ডব্লিউসিও) অনুমোদিত আন্তর্জাতিক চুক্তি ও কনভেনশন অনুযায়ী এবং আন্তর্জাতিক উত্তমচর্চা যেমন: অনুমোদিত অর্থনৈতিক অপারেটর (এইও), পারস্পরিক স্বীকৃতি চুক্তি (এমআরএ), ইলেকট্রনিক ঘোষণা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিট (পিসিএ) প্রভৃতি নতুন আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শিগগিরই গেজেট জারির মাধ্যমে নতুন কাস্টমস আইনের কার্যকারিতা দেওয়া হবে। এনবিআর-এর সদস্য (শুল্কনীতি) মাসুদ সাদিক যুগান্তরকে বলেন, নতুন কাস্টমস আইন সংসদে পাশ হয়েছে। আইনটি বাস্তবায়নের জন্য অনেক সাধারণ আদেশ, প্রজ্ঞাপন জারি এবং অনুবাদের প্রয়োজন আছে। এসব কাজ শেষ হলে গেজেট জারির মাধ্যমে নতুন আইনের কার্যকারিতা দেওয়া হবে।
আমদানি-রপ্তানিকারক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন কাস্টমস আইনে শিল্পবান্ধব বেশকিছু বিধান রাখা হয়েছে। এ কারণে আমদানি পণ্য ছাড়করণে হয়রানি কমে আসবে। অন্যদিকে নতুন কিছু ধারা যুক্ত করা হয়েছে, যা শিল্পের ব্যয় বাড়িয়ে দেবে। নতুন আইনে আদতে কাস্টমস কর্মকর্তাদের ক্ষমতা হ্রাসের কথা বলা হলেও ক্ষেত্রবিশেষে তা বহুলাংশে বাড়ানো হয়েছে। এতে হয়রানি বাড়তে পারে। যেমন: আইনের ১৫৪ ধারায় বলা আছে, বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের কাস্টমসের কাছে ব্যাগেজ সম্পর্কে তথ্য দিতে হবে। যাত্রী বা ক্রু ব্যাগেজে রক্ষিত পণ্য সম্পর্কে কাস্টমস কর্মকর্তার কাছে লিখিত বা মৌখিক ঘোষণা দিতে পারবেন এবং কাস্টমস কর্মকর্তার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। ব্যাগেজ তল্লাশির আগে যাত্রী যদি ব্যাগেজে রক্ষিত পণ্য সম্পর্কে সঠিত তথ্য দিতে ব্যর্থ হন এবং তল্লাশিকালে ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য পাওয়া যায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কাস্টমস কর্মকর্তা সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা করতে পারবেন।
আইনের ৩২ ধারায় বলা আছে, আমদানি পণ্যের শুল্ক-কর, চার্জ নির্ধারণের পর তা ১০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এ সময় অতিক্রম করলে শুল্ক-কর পরিশোধের সর্বশেষ তারিখ থেকে খালাসের সময় পর্যন্ত বার্ষিক ১০ শতাংশ হারে সাধারণ সুদ পরিশোধ করতে হবে। এছাড়াও শুল্ক-কর বকেয়া থাকলে বকেয়া অর্থের ওপরেই ১০ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। এতে ব্যবসার খরচ বাড়তে পারে। বর্তমানে বন্দরে পণ্য ফেলে রাখলে কাস্টমসের জরিমানা নেই, শুধু পোর্ট ও শিপিং ডেমারেজ দিতে হয়। নতুন আইনটি কার্যকর হলে কাস্টমসের জরিমানা যুক্ত হবে।
আইনের ৮২ ধারায় বলা আছে, পণ্য ঘোষণা বা বিল অব এন্ট্রিতে দেওয়া তথ্যের সত্যতা, সঠিকতা সম্পর্কে আমদানিকারক-রপ্তানিকারক দায়বদ্ধ থাকবে। একই সঙ্গে পণ্য খালাসে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টও দায়ী থাকবে। পণ্যের সঠিকতা যাচাইয়ে কাস্টমস কর্মকর্তা দলিলাদি চাইতে পারবেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তথ্য না দিলে সংশ্লিষ্ট আমদানি-রপ্তানিকারককে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হবে।
আইনের ৮৪ ধারায় বলা আছে, কাস্টমস স্টেশনে পণ্য নামার পর আমদানিকারককে ৫ দিনের মধ্যে পণ্যের ঘোষণা বা বিল অব এন্ট্রি জমা দিতে হবে। চাইলে পণ্য বন্দরে পৌঁছানোর ৩০ দিন আগেও বিল অব এন্ট্রি জমা দেওয়া যাবে। এ নিয়ম ভঙ্গ করলে আমদানিকারককে সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হবে।
উল্লিখিত ধারাগুলোর হয়রানি বাড়ার পাশাপাশি ব্যবসার খরচ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। যদিও আইনে আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার অংশ হিসাবে বেশকিছু নতুন ধারা যুক্ত করা হয়েছে। যে কারণে আমদানিকারকদের হয়রানি হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, আইনের ৮৬ ধারায় বলা আছে, আমদানিকারক-রপ্তানিকারক চাইলে মূল কাগজপত্রের (প্রোফরমা ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট, এলসি ডকুমেন্ট প্রভৃতি) সঙ্গে সংগতি রেখে কমিশনারের কাছে আবেদনের মাধ্যমে একাধিকবার বিল অব এন্ট্রি সংশোধন করতে পারবেন। তবে পণ্য পরীক্ষার কথা জানানো হলে বা কাস্টমস কর্মকর্তার দ্বারা পণ্যের বিবরণ সঠিক প্রতিষ্ঠিত হলে বিল অব এন্ট্রি সংশোধন করা যাবে না।
অন্যদিকে ১৭১(২) ধারায় বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কাস্টমস কর্মকর্তার কাছে বিল এন্ট্রিতে উল্লিখিত পণ্যের বিবরণের (পণ্যের পরিমাণ, গুণাগুণ, প্রকৃতি, শ্রেণিবিন্যাস, শুল্কায়নযোগ্য মূল্য, উৎস দেশের সঠিকতা) ত্রুটি উল্লেখ করে দোষ স্বীকার করেন, তাহলে মিথ্যা ঘোষণার দায়ে জরিমানা আরোপ করা হবে না। এক্ষেত্রে আমদানিকারককে পণ্য অ্যাসেসমেন্ট বা কায়িক পরীক্ষার আগে ঘোষণা দিতে হবে। পণ্য অ্যাসেসমেন্ট বা কায়িক পরীক্ষার জন্য বাছাই হলে এ সুবিধা পাওয়া যাবে না।
যদিও ইচ্ছাকৃত রাজস্ব ফাঁকিবাজদের মিথ্যা ঘোষণার জরিমানা বাড়ানো হয়েছে। আইনের ১৭২ ধারায় বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি একই অপরাধ পুনরাবৃত্তি করেন বা দ্বিতীয়বার সংঘটন করেন, তাহলে প্রথববার আরোপিত জরিমানা বা অর্থদণ্ডের দ্বিগুণ জরিমানা বা অর্থদণ্ড আরোপ করা হবে। অর্থাৎ যদি কোনো আমদানিকারক মিথ্যা ঘোষণার দায়ে একবার জরিমানা বা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হন, পরবর্তী সময়ে একই ধরনের অপরাধ বা মিথ্যা ঘোষণা প্রমাণিত হলে দ্বিগুণ হারে জরিমানা আরোপ করা হবে।