নেপাল, ভুটান ও ভারতের সাত প্রদেশের ভ্রমণকারীরা বেশি ব্যবহার করবে * আরও ৯১২ দশমিক ৯০ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে, ব্যয় হবে ৪ হাজার ৬শ কোটি টাকা * বিনিয়োগ করতে চায় নেপাল ও ভুটান, বরাদ্দ পাওয়া গেলে ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে কার্যক্রম শেষ করবে বেবিচক
নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশাপাশি ‘আঞ্চলিক হাব’ করার কাজ শুরু করেছে সরকার। এজন্য বিমানবন্দরটি ঘিরে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বেবিচক। যদিও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আপত্তির কারণে জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম থমকে গিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তি পাওয়ায় ফের জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম দ্রুত চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ করতে লাগবে ৪ হাজার ৬শ কোটি টাকা। এছাড়া থমকে থাকা সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রমও শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে, অর্থ সংকট ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আপত্তির কারণে সৈয়দপুর ও সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম স্থগিত ছিল। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে অনাপত্তি প্রদান করা হয়েছে। গত মাসে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এক চিঠিতে বেবিচককে এই দুই বিমানবন্দরের জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম দ্রুত শুরুর নির্দেশনা দেয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালে নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আঞ্চলিক বিমানবন্দর হিসাবে রূপান্তরের ঘোষণা দেন। এরপর সিভিল এভিয়েশন সৈয়দপুরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার লক্ষ্যে জরিপ কাজ পরিচালনার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ান একটি ফার্মকে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে জরিপ শেষ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আঞ্চলিক বিমানবন্দর করতে হলে আশপাশের ৯১২ দশমিক ৯০ একর জমি অধিগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য একটি মাস্টারপ্ল্যানও করা হয়। ৯১২ একর জমির মধ্যে নীলফামারী জেলার আওতাধীন জমির পরিমাণ প্রায় ৫০০ একর। জমি অধিগ্রহণের জন্য ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। ওই বছরই কয়েক হাজার মালিককে নোটিশ দেওয়া হয়। তৈরি করা হয় বিমানবন্দরের নকশাও। কথা ছিল ভূমি উন্নয়ন কার্যক্রমের পর চার বছর সময়সীমার মধ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণ করা হবে। তবে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া থমকে যাওয়ায় আটকে যায় পুরো কার্যক্রম। তবে এবার খুব দ্রুত জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করতে চায় মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি বেবিচককে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
এভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আকাশপথে যাত্রী পরিবহণে কক্সবাজারের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর সৈয়দপুর। দেশের সবচেয়ে উত্তরের এই বিমানবন্দরটি ১৩৬ দশমিক ৫৯ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। রাজধানী ঢাকা থেকে ২৬০ কিলোমিটার উড্ডয়ন দূরত্বে অবস্থিত যা আকাশপথে অতিক্রম করতে সময় লাগে মাত্র ৪৮ মিনিট। ভৌগোলিক সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোর যাত্রী পরিবহণ ছাড়াও নেপাল, ভুটান ও ভারতের সেভেন সিস্টার্সখ্যাত সাত প্রদেশে ভ্রমণকারীদের অন্যতম পছন্দ বাংলাদেশি এ বিমানবন্দর। সৈয়দপুর পৌঁছে এরপর আশপাশের যেকোনো স্থলবন্দর ব্যবহার করে প্রতি বছর প্রচুর পর্যটক প্রতিবেশী দেশগুলোয় ভ্রমণ করে। সৈয়দপুর থেকে নেপাল, ভুটান ও ভারতের উত্তর-পূর্বের সেভেন সিস্টার্সখ্যাত ৭ রাজ্যের নিকটতম বিমানবন্দরগুলেতে যেতে আকাশপথে ৩০ থেকে ৫০ মিনিট সময় লাগে। ত্রিদেশীয় ভ্রমণকারীরা এখন ভেঙে ভেঙে সৈয়দপুর বিমানবন্দর ব্যবহার করছে। এটি আন্তর্জাতিক রূপ পেলে ওই তিন দেশের বিদেশযাত্রীরাও ভৌগোলিকভাবে কম দূরত্বের কারণে সৈয়দপুরকে বেছে নেবে। এতে বাংলাদেশের এভিয়েশন সেক্টর সম্প্রসারণের পাশাপাশি সরকারও রাজস্ব পাবে। এখান থেকে কার্গো বিমান চলাচল করলে খুব সহজেই দেশের উৎপাদিত পণ্য, বিশেষ করে কৃষিপণ্য সহজেই, স্বল্প সময়ে পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, ভুটান ও ভারতে পরিবহণ করা যাবে। এতে করে কৃষকদের অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হবে।
বেবিচক কর্মকর্তারা বলছেন, এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য নেপাল অনেকাংশেই ভারতীয় বন্দরের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু যেহেতু ভারতের নিজের বাণিজ্যই বিশাল পরিসরের, তাই পণ্য পরিবহণে নেপালকে বাড়তি সময় দিতে হয়। সেক্ষেত্রে সৈয়দপুর থেকে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার ‘চিকেন নেক’সদৃশ স্বল্প দূরত্বের সড়ক ও আকাশপথ উভয় রুটে পণ্য ও যাত্রী পরিবহণ সুবিধা পেতে চায় নেপাল। গত বছর নেপালের পোখারায় অনুষ্ঠিত দুই দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বৈঠকে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে সুতা রপ্তানির প্রস্তাবও দিয়েছে দেশটি।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রদীপ কুমার গাইওয়ালি বাংলাদেশ সফরকালে সৈয়দপুর বিমানবন্দর ব্যবহার করার প্রস্তাব করেন। ভুটানের অর্থনীতিবিষয়ক সেক্রেটারি কারমা শেরিং ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফরকালে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সৈয়দপুর বিমানবন্দর ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন।
প্রতিবেশী ভারত-ভুটান ও নেপালের সৈয়দপুর বিমানবন্দর নিয়ে আগ্রহ রয়েছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব এটিকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তর করতে পারলে তা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদ উল আলম যুগান্তরকে বলেন, সৈয়দপুর বিমানবন্দর আন্তর্জাতিকে উন্নীত হলে বাংলাদেশের এভিয়েশন খাত সম্প্রসারিত হওয়ার পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আরও গতি পাবে। স্থানীয়দের কর্মসংস্থানও বাড়বে, যা দেশের অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখবে।
সৈয়দপুর বিমানবন্দর সূত্র জানায়, সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রূপান্তরে আরও অনেক অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, রানওয়ে সম্প্রসারণ, আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল, কার্গো টার্মিনাল, কন্ট্রোল টাওয়ার, পাওয়ার হাউজ, পাম্প হাউজ, ফায়ার স্টেশন, প্রশাসনিক ভবন, অপারেশন ভবন, ভিআইপি ও ভিভিআইপি লাউঞ্জ, আবাসিক কোয়ার্টারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। এর জন্য এখন প্রয়োজন টাকা।
বেবিচক সূত্র জানায়, নেপাল-ভুটান এই বিমানবন্দরের উন্নয়নের জন্য টাকা বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত রয়েছে। টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেলে ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে কার্যক্রম শেষ করা সম্ভব হবে।
সৈয়দপুর বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক সুপ্লব কুমার ঘোষ জানান, রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা বাংলাদেশ বিমান ও বেসরকারি অপারেটর ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ও নভোএয়ার এখান থেকে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। কাজ শেষ হলে এটি হবে দেশের পঞ্চম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।