হরতাল-অবরোধে জরুরি প্রয়োজনে যাত্রীরা এতদিন তুলনামূলক নিরাপদ যান হিসাবে বিবেচনা করতেন ট্রেনকে। সাম্প্রতিক সময়ে রেলপথে পড়েছে নাশকতাকারীদের থাবা। গত দেড় মাসে এ পথে অন্তত সাতটি নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। সামনে আরও নাশকতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিষয়টি মাথায় রেখে ট্রেন ও রেলপথ নিরাপদ রাখতে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে সারা দেশের রেলপথগুলোয় সাড়ে আট হাজার আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। রেলের নিজস্ব স্থাপনার নিরাপত্তায় আরও ২ হাজার ৭০০ আনসার সদস্য মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, সারা দেশের সব স্টেশন, রেলপথ এবং ট্রেনের গুরুত্বপূর্ণ বগিগুলোয় জরুরি ভিত্তিতে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বুধবাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভায় এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সভায় নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের রাতে না ঘুমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সভা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
এদিকে মঙ্গলবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ট্রেনের অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিহত চারজনের মধ্যে দুজনের লাশ বুধবার পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অপরদিকে নাশকতার ঘটনায় অজ্ঞাতদের আসামি করে ঢাকা রেলওয়ে থানায় একটি মামলা হয়েছে। তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তেজগাঁওয়ের নাশকতাকারীরা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠে। অগ্নিসংযোগকারীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। শিগগিরই তারা ধরা পড়বে।
কোর কমিটির সূত্রে জানা যায়, সামনের দিনগুলোয় সরকারবিরোধী অন্দোলন আরও জোরালো হতে পারে। ওই সময় সরকারকে বিব্রত করতে রেলে ব্যাপক নাশকতার শঙ্কা রয়েছে। সম্ভাব্য নাশকতা মোকাবিলায় রেলের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি), জেলা পুলিশ, রেলওয়ে পুলিশ এবং আনসারবাহিনীকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রেলওয়ে পুলিশ ও আরএনবিকে রেল স্টেশন এবং ট্রেনের ভেতরের নিরাপত্তা দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর বাইরের (রেলপথ) নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জেলা পুলিশ এবং আনসার ও গ্রামপ্রতিরক্ষা বাহিনীকে। আনসার সদস্যরা জেলার প্রশাসন এবং রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবে।
আনসারবাহিনী মোতায়েনের পর ট্রেনে কেন নাশকতা ঘটছে-জানতে চাইলে আনসার ভিডিপির মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল একেএম আমিনুল হক যুগান্তরকে বলেন, যেসব পথ সাধারণত অনিরাপদ মনে হয়, সেই পথগুলোতেই আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। গাজীপুরের যেখানে নাশকতা ঘটেছে, সেই পথ সাধারণত নিরাপদ হিসাবেই বিবেচিত। এ কারণে সেখানে আনসার সদস্য মোতায়েন ছিল না। তিনি বলেন, প্রতি তিন কিলোমিটারের জন্য চারজন করে আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। শীতে প্রচণ্ড কষ্ট করে তারা কাজ করছেন। এ মুহূর্তে যত আনসার সদস্য রেলের নিরাপত্তায় কাজ করছেন, তা পর্যাপ্ত নয়। তাই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আরও আনসার সদস্য চেয়েছে। আমরা বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখে পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভায় অংশ নেওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, নাশকতার জাল সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে আনসার সদস্যরাই ৩২টি নাশকতার প্রচেষ্টা রুখে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমার কর্মকর্তারা রাতে ঘুমান না। একটি বাহিনীপ্রধান হওয়ার পরও আমি রাতে ঘুমাই না। রাতে রেললাইন ও স্টেশন ঘুরেফিরে দেখি। তিনি বলেন, সভায় রেলস্টেশনে তল্লাশি কার্যক্রম বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিনটি গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান, পুলিশের আইজি, বিজিবিপ্রধান এবং ডিএমপি কমিশনারসহ সরকারের পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, যারা অসহযোগ আন্দোলন করছেন, তাদের বাসা থেকে বিদ্যুৎ যদি চলে যায়, পানি যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে কী হবে। তারা কি সেটা বুঝতে পারছেন?’ তিনি বলেন, ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপি ক্রমাগতভাবে নাশকতা চালিয়ে যাচ্ছে। বাসের ভেতরে অগ্নিদগ্ধ করে, হেলপারসহ পুড়িয়ে, তারপর এখন শুরু করেছে রেললাইন উপড়ে ফেলে দেওয়া। চারজন মানুষকে তারা চলন্ত ট্রেনে পুড়িয়ে মেরেছে। এর আগেও গাজীপুর এলাকায় একটি ঘটনা ঘটিয়েছে। এ ধরনের নাশকতা তারা ক্রমাগতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ৯০ দিন ক্রমাগতভাবে তারা এসব করেছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে, সম্পদ ধ্বংস করেছে, জায়গায় জায়গায় রাস্তাঘাট কেটে দিয়েছে। এখন আবার একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কীভাবে সৃষ্টি করা যায়, সেজন্য পাঁয়তারা করছে। বিএনপির অসহযোগ আন্দোলনের ডাকের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, এদেশের জনগণ এ ধরনের ডাকে কোনোদিনই সাড়া দেয়নি।
রেলওয়ে পুলিশ ঢাকা জেলার এসপি আনোয়ার হোসেন বলেন, তেজগাঁওয়ে ট্রেনে নাশকতার ঘটনায় কমলাপুর রেলওয়ে থানায় রেলওয়ের ট্রেন পরিচালক খালেদ মোশাররফ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। রেলওয়ে পুলিশ এর তদন্ত করছে। আমরা নাশকতাকারীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। এখনো বলার মতো কোনো অগ্রগতি হয়নি। তিনি জানান, অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে করা মামলায় বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং চারজনকে হত্যায় পৃথক অভিযোগ আনা হয়েছে।
মঙ্গলবার ভোর ৫টায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে মা ও শিশুসহ চারজন নিহত হন। বুধবার বিকাল ৩টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে খোকন মিয়া (৩৫) ও রশিদ ঢালীর (৬০) লাশ বুঝে নেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। নিহত নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) এবং তার তিন বছরের ছেলে ইয়াসিনকে মঙ্গলবারই শনাক্ত করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে ঢাকা রেলওয়ে থানার এসআই সেতাফুর রহমান বলেন, মরদেহ হস্তান্তর করার আগে দুজনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে।
খোকন সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর উপজেলা জুলসা গ্রামের মৃত নুর ইসলামের ছেলে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। নারায়ণগঞ্জ বিসিক এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে থাকতেন তিনি। স্ত্রী সাজনা আক্তার এবং তিনি ক্রোনি গ্রুপের অবন্তী কালার টেক্সটাইল কারখানায় কাজ করতেন। মৃত রশিদ ঢালী নেত্রকোনা সদর উপজেলার নাগরা গ্রামের মৃত বশির ঢালীর ছেলে। দুই ছেলে ও এক মেয়ের বাবা তিনি। স্ত্রীর নাম পেয়ারা বেগম।
ট্রেনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে ডিবি তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আশরাফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে ডিবির তিনটি বিভাগ ছায়া তদন্ত করছে। রেলওয়ে পুলিশ মূল তদন্ত করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য ইউনিটের সদস্যরাও কাজ করছেন। তিনি বলেন, নাশকতাকারীরা বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেন।