দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে প্রচার চালানোর দায়ে অন্তত ৩২ জন সরকারি চাকরিজীবীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
তাদের বেশির ভাগই শিক্ষক, শিক্ষা কর্মকর্তা ও প্রকৌশলী। ১৩টি আসনে এসব চাকরিজীবী পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালানোর ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি।
ওই ৩২ জন ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সরকারদলীয় সংসদ-সদস্য মো. নজরুল ইসলাম বাবুর স্ত্রী ডা. সায়মা আফরোজ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য প্রফেসর ড. বিশ্বজিত চন্দ ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের যুগ্মসচিব একেএমজি কিবরিয়ার নির্বাচনি প্রচারে অংশ নেওয়া সরকারি চাকরিবিধির লঙ্ঘন কি না, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিতে যাচ্ছে ইসি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনের পর এসব চাকরিজীবীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
যদিও এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগে শেষ করে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। ওই আইনে অপরাধভেদে বিভাগীয় মামলা, তিরস্কার, পদাবনতি, চাকরিচ্যুতসহ বিভিন্ন ধরনের সাজার বিধান রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বুধবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, সরকারি কয়েকজন চাকরিজীবী চাকরিবিধি লঙ্ঘন করার ঘটনায় কমিশন ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। তবে কতজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তা এ মুহূর্তে বলতে পারছি না।
ইসি সূত্রে জানা যায়, যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তারা ঢাকা-১৮, গাজীপুর-৩, নারায়ণগঞ্জ-২, ঠাকুরগাঁও-২, নাটোর-৪, সিরাজগঞ্জ-৫, যশোর-৫, কুমিল্লা-২ ও ১১, বরিশাল-৫, পাবনা-৩, নেত্রকোনা-১ ও বগুড়া-২ নির্বাচনি এলাকায় প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন। এর আগে নির্বাচনি প্রচার চলাবস্থায় কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় ইসি।
স্ত্রীর নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নেওয়ায় বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি হামিদুল আলমকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তিনি বগুড়া-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহাজাদী আলম ওরফে লিপির পক্ষে প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন। এবার রাজধানীর নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়ে ঢাকা-১৮ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালানোর ঘটনায় অন্তত তিনজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তারা হলেন নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহিনুর মিয়া, উত্তরা গার্লস হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি নুরুল আমীন এবং কামারপাড়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ খুরশিদ জাহান। তারা সবাই ১৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ওই সমাবেশে এ আসনের তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ হাবিব হাসানের পক্ষে বক্তব্য দেন। যদিও এ আসনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়। হাবিব হাসান শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন না।
গাজীপুর-৩ আসনে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী রুমানা আলী। নতুন মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন তিনি। এ প্রার্থীর পক্ষে ৫ ডিসেম্বর প্রচার চালানোর দায়ে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা শওকত আলী মৃধার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে ইসি।
ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সংসদ-সদস্য মো. মাজহারুল ইসলাম সুজনের পক্ষে প্রচার চালানোয় শহিদ আকবর আলী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগারিক মো. মোমিনুল ইসলাম ভাসানী, নাটোর-৪ আসনের সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালানোয় শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি মহিলা কলেজের প্রভাষক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বাবলু ও সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালানোয় চৌহালী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আরিফ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ-২ আসনে বেশ কয়েকজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. নজরুল ইসলাম বাবুর পক্ষে নির্বাচনি মিছিল করেন। এ অপরাধে আটজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তারা হলেন সেন্ট্রাল করোনেশন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, গোপালদী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সাদেকুর রহমান কামাল, জাঙ্গালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহেদুল হক, উজানগোবিন্দী বিনাইরচর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আনোয়ার উজ-জামান খান, জাহানারা বেগম উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফজলুল হক, ৮৩নং মুকুন্দী গাজীপুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লোকমান হোসেন, আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য সহকারী লুৎফুন্নাহার বেগম ও রোকনউদ্দিন মোল্লা গার্লস উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মইনুল হোসেন মানিক। ওই আটজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হিসাবে তালিকাভুক্ত ছিলেন। তাদের নির্বাচনি দায়িত্ব থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
এখন তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে বলা হচ্ছে। একই অভিযোগে নজরুল ইসলাম বাবুর স্ত্রী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সায়মা আফরোজ চাকরিবিধি লঙ্ঘন করেছেন কি না, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এছাড়া যশোর-৫ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী স্বপন ভট্টাচার্য্যরে পক্ষে সরাসরি প্রচার চালানোয় মুক্তেশ্বরী ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক মো. মামুনর আর রশিদ ও ঢাকুরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ তাপস কুমার কুন্ডুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও এ আসনে স্বপন ভট্টাচার্য্য জয়ী হতে পারেননি। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. ইয়াকুব আলী নির্বাচিত হয়েছেন।
কুমিল্লা-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিমা আহমাদের পক্ষে প্রচারে অংশ নেওয়ায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে।
বরিশাল-৫ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্য কর্নেল জাহিদ ফারুকের পক্ষে লিফলেট বিতরণ করায় ৫নং মধ্য কড়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নাজমিন আক্তারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করতে যাচ্ছে ইসি। একইভাবে পাবনা-৩ আসনের ১০, ঠাকুরগাঁও-২ আসনের একজন, নেত্রকোনা-১ আসনের একজন এবং বগুড়া-২ আসনের একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হচ্ছে।