ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনকে ‘লোকদেখানো’ ও ‘হাস্যকর’ বলে হাইকোর্ট অভিহিত করেছেন। আদালত বলেছেন, শিশু আয়ানের খতনায় যে পরিমাণ ওষুধ ব্যবহার হয়েছে, হার্টের বাইপাস সার্জারিতেও এত ওষুধ দেওয়া হয় না। সোমবার তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর শুনানির সময় বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। আর প্রতিবেদনটিকে রিটকারী আইনজীবী ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ আখ্যা দিয়ে পুনঃতদন্তের আদেশ চেয়ে আদালতে আবেদন করেছেন। আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদন হলফনামা আকারে আদালতে জমা দেয় রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায় এবং রিটের পক্ষে অ্যাডভোকেট এবিএম শাহজাহান আকন্দ মাসুম আদালতে শুনানি করেন। দুই পক্ষের শুনানি শেষে ১১ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির দিন রেখেছেন আদালত। রিটকারী আইনজীবীকে ওইদিন পুনঃতদন্তের আবেদন হলফনামা আকারে জমা দিতে বলা হয়েছে।
এদিন অ্যাডভোকেট মাসুম কথা বলার অনুমতি চাইলে জ্যেষ্ঠ বিচারক তাকে পরে সুযোগ দেওয়া হবে বলে জানান। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতিবেদন পড়ার সময় জ্যেষ্ঠ বিচারক জানতে চান-মৃত্যুর পর সুরতহাল হয়েছে কি না। ‘হয়নি’ বলে তিনি জানান। প্রতিবেদনের এক জায়গায় বলা হয়েছে, আয়ানের ব্রঙ্কাইটিসের সমস্যা ছিল এবং সেজন্য তাকে স্টেরয়েড দেওয়া হয়। এ সময় জ্যেষ্ঠ বিচারক প্রশ্ন করেন, বিষয়টি জানা থাকার পরও তারা কেন অপারেশন করলেন? একপর্যায়ে আদালত প্রতিবেদন জমাদানকারী কর্মকর্তাকে ডেকে কিছু বিষয় জানতে চান। আয়ানের ব্রঙ্কাইটিসের সমস্যা জানার পরও তাকে অপারেশন করা ‘উচিত হয়নি’ বলে মন্তব্য করেন জ্যেষ্ঠ বিচারক। তিনি বলেন, কী এমন তাড়া ছিল যে ওইদিনই তার অপারেশন করতে হবে? দু-চারদিন পর হলে এমন কী ক্ষতি হতো? এরপর রিটকারী আইনজীবী মাসুমকে ডাকেন আদালত। প্রতিবেদনকে তিনি ‘সম্পূর্ণ পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে অভিযোগ করেন। প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন। প্রতিবেদনে চারটি সুপারিশ করা হলেও সেগুলো ‘অস্পষ্ট’ উল্লেখ করে তিনি আদালতের কাছে পুনঃতদন্তের আদেশ চান। জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, আপনি অ্যাফিডেভিট করে আনেন, অর্ডার দেব। এটা আইওয়াশ, হাস্যকর।
প্রতিবেদন থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক ডা. পরিমল কুমার পাল বলেন, আয়ানের হার্টরেট, ব্লাড প্রেশার স্বাভাবিক ছিল। অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার আগে তাকে স্টেরয়েড দিয়ে নেবুলাইজেশন করানো হয়। প্রিকশান (পূর্ব সতর্কতা) হিসাবে দেওয়া হয়। তখন আদালত বলেন, স্টেরয়েড দিয়েছেন! স্টেরয়েড ভালো মানুষকে দিলেও পার্শ্ব প্রতিক্রয়া হয়। জবাবে ডা. পরিমল বলেন, স্টেরয়েডটা লাইফ সেভিং (জীবন রক্ষাকারী) গার্ড। আদালত বলেন, স্টেরয়েডে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হবেই। যাদের বাইপাস হচ্ছে, তাদেরও এত ওষুধ দেওয়া হয় না। বাইপাসের জন্য এত ওষুধ লাগে না, আপনারা (আয়ানের ক্ষেত্রে) যে পরিমাণ ওষুধ দিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে আয়ানের মৃত্যুর নির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত না করে কয়েকটি সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। শিশুটির এমন মৃত্যুর জন্য সরাসরি কাউকে দায়ী না করে ভবিষ্যতে এ ধরনের মৃত্যু এড়াতে চার দফা ?সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হলো-হাসপাতালে একাধিক অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া। রোগী ও রোগীর আত্মীয়স্বজনকে অ্যানেস্থেসিয়া ও অপারেশনের ঝুঁকিগুলো ভালোভাবে অবহিত করা। হাসপাতালে আইসিইউ-এর ব্যবস্থা রাখা এবং সরকারের অনুমোদনের পর হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করা।
উল্লেখ্য, পাঁচ বছর বয়সি আয়ানকে খতনা করানোর জন্য গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার সাঁতারকুল এলাকার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালে নিয়ে যায় তার পরিবার। অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার পর তার আর জ্ঞান ফেরেনি। পরে তাকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। ৭ জানুয়ারি সেখানে শিশুটির মৃত্যু হয়। আয়ানের বাবা শামীম আহামেদ বাড্ডা থানায় মামলা করেন। ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট সাইদ সাব্বির আহমেদ, সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক তাসনুভা মাহজাবিন, অজ্ঞাতনামা পরিচালকসহ কয়েকজনকে আসামি করা হয়। পরে জানা যায়, যথাযথ নিবন্ধন ছাড়াই চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল। এ কারণে হাসপাতালের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আয়ানের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন যুক্ত করে ৯ জানুয়ারি হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এবিএম শাহজাহান আকন্দ মাসুম।