আগামী ২০২৬ সালের জুন মাসের মধ্যে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ঋণ পরিশোধে আর কোনো বাড়তি সুবিধা দেয়া হবে না। এছাড়া ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে সীমার বাইরে দেয়া ঋণ, বেনামি স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঋণ এবং জালিয়াতি/প্রতারণার মাধ্যমে দেয়া ঋণ কমিয়ে শূন্যে আনতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এজন্য একটি পথনকশা (রোডম্যাপ) ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় ‘দেশের ব্যাংকিং খাতের শ্রেণিকৃত ঋণ হ্রাস এবং করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করার’ এই রোডম্যাপ অনুমোদন দেয়া হয়। এরপর এক সংবাদ সম্মেলনে পথনকশার বিস্তারিত তুলে ধরেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাছের। এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাছের বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। ব্যাংকিং আইন বজায় রেখে ও গত তিন বছরের শ্রেণিকৃত ঋণের তথ্য পর্যালোচনা করে ১১ দফার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করতে পরলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে। কোনো গ্রাহক ঋণ নিয়মিত পরিশোধ না করলে তাকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করবে। খেলাপিরা সমাজের অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। আগামীতে খেলাপিরা জ?মি কিনতে গেলে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবে না। নতুন প্রতিষ্ঠান কিংবা কোম্পানি চালু কিংবা ব্যবসা স¤প্রসারণ করতে পারবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠি দেবে যেন তাদের কোনো সহযোগিতা না করে। গাড়ি-বাড়ি কিনতে পারবেন না। এমন অবস্থায় পড়তে কোনো ব্যবসায়ী চাইবে না। তাই তারা ঋণ নিয়মিত পরিশোধ করবেন।
বেনামে ঋণ কত জানতে চাইলে ডেপুটি গভর্নর বলেন, বেনামে ঋণ চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। তাই কত আছে এর সঠিক তথ্য নেই। পত্র-পত্রিকায় বেনামে ঋণের তথ্য আসছে তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে যেহেতু লিখা হচ্ছে কিছু না কিছু আছে, এটি চিহ্নিত করা হবে।
তিনি বলেন, দুর্বল ব্যাংক সংস্কারের বড় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মূলধন খেলাপি ঋণসহ চারটি সূচকের মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করা হবে। সবল কোনো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত হবে। গত ব্যাংকার্স সভায় ব্যাংকগুলোকে বলে দেয়া হয়েছে যারা দুর্বল তারা আগে থেকে প্রস্তুতি নেবে কার সঙ্গে একীভূত হবে। যদি কেউ এ ধরনের প্রস্তুতি না নেয় তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে একীভূত করে দেবে।
আবু ফারাহ মো. নাছের জানান, নতুন পথনকশায় ব্যাংক খাতের খেলাপিদের আর ছাড় না দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ অবলোপন ও অবলোপন ঋণ আদায় জোর করা হবে। এছাড়া দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মার্জ করার পরিকল্পনাও হাতে নেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে সীমার বেশি ঋণ না দেয়া, যোগ্য স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ এবং শেয়ারধারী পরিচালকদের যোগ্যতা নির্ধারণ করার বিষয়েও পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।
রোডম্যাপ অনুযায়ী, আগামী ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী,
বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা।
খেলাপি ঋণ কমানোর পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকের কোনো ঋণ একাধারে দুই বছর খেলাপি থাকলে (যা বর্তমানে তিন বছর) সেসব ঋণের বিপরীতে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রেখে অবলোপন করতে হবে। শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে ব্যাংকের কোনো ঝুঁঁকি তৈরি হবে না। এছাড়া অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে ‘অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট’ নামে একটি পৃথক ইউনিট গঠন করা হবে। এই ঋণ আদায়ের লক্ষ্য অর্জন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের পারফর্ম্যান্সে যুক্ত করা হওয়ার কথা রোডম্যাপে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ঋণ পরিশোধের জন্য দেয়া বাড়তি মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না। এর ফলে ব্যাংকের তারল্য সংকট কমবে। ব্যাংকের মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে। এজন্য খেলাপি ঋণ আদায় করা কর্মকর্তাদের জন্য বিশেষ ভাতা চালুর কথাও বলা হয়। ঋণের জামানত বাধ্যতামূলকভাবে তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে দিয়ে মূল্যায়ন করাতে হবে।
এদিকে ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে ৬টি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ব্যাংকের শেয়ারধারী পরিচালকদের যোগ্যতা ও দায়িত্ব-কর্তব্যসম্পর্কিত নীতিমালা সংশোধন করা হবে। ফলাফল হিসেবে ব্যাংকের সামগ্রিক ঋণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হবে। রোডম্যাপ অনুযায়ী, ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ, তাদের সম্মানী নির্ধারণ এবং দায়িত্ব-কর্তব্যসম্পর্কিত নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। এতে স্বতন্ত্র পরিচালকরা আমানতকারী ও শেয়ারধারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে।