নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের লাগামহীন দামে রীতিমতো দিশেহারা মানুষ। নানা অজুহাতে প্রায় সব পণ্যের দাম ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে পকেট কেটে চলেছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা। তিন বছর ধরে এ অপচেষ্টা প্রায় অপ্রতিরোধ্য। সরকার, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা, ভোক্তার দাবি–কোনো কিছুতেই গা করছেন না তাঁরা। পেঁয়াজ, চিনি, আটা, ডাল, ভোজ্যতেল, মাংস, ডিম, আলুসহ প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম শুধু সরকারি হিসাবেই গত এক বছরে ৩ শতাংশ থেকে ১৬৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সরকারের দেওয়া শুল্কছাড়, এলসি-সুবিধাসহ কোনো সহায়তায়ই ভোক্তার কোনো লাভ হয়নি। বরং ব্যবসায়ীদের পকেট ভারী হয়েছে। অথচ বিশ্ববাজারে প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম কমে গেছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) গত সপ্তাহে দেওয়া তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত জানুয়ারিতে খাদ্যপণ্যের দাম গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। এর মধ্যেও ব্যবসায়ীদের আবদার মেনে শুল্কছাড় দেওয়া হচ্ছে। এতে সরকারের বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ক্ষতি হলেও ভোক্তারা বলতে গেলে এর সুফলই পান না। রাজস্ব বিভাগও শুল্ককর ছাড়ের সুফল ভোক্তা পেল কি না, তার তদারকি করে না। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বাজারদরে নৈরাজ্যের দায়ে তথ্য-প্রমাণসহ শক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে দাম সহনীয় হবে না।
তথ্য-উপাত্ত বলছে, দুই বছর ধরে নানা কারণে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম কিছুটা অস্থির ছিল। তবে ক্রমেই তা সহনীয় হয়ে আসে। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে দেশে যে হারে দাম বেড়েছে, তা সহনীয় তো নয়ই; বরং অব্যাহতভাবে বেড়েছে। শুধু যে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে তা-ই নয়, স্থানীয়ভাবে উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরও সব ধরনের শাকসবজি, মাছ, মাংসের দামও বেড়েছে লাগামহীন। বলা যায়, রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছেন তাঁরা।
বাজারে ভোক্তারা যে দামে পণ্য কিনছেন, তার চেয়ে অনেক কমিয়ে মূল্যতালিকা প্রকাশ করে যাচ্ছে সরকারি সংস্থা টিসিবি। এ তালিকার প্রতি ভোক্তার আস্থা কম থাকলেও, ওই সংস্থাটির গতকালের মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেও জিনিসপত্রের দাম বাড়ার অস্থিরতার চিত্র পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, গত এক বছরে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১৬৪ শতাংশের বেশি। চিনির বেড়েছে ১৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ, আটার বেড়েছে ১৪ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, ডালের দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ২৬ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগির বেড়েছে ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এ ছাড়া চাল, গরুর মাংস, ডিম, আলুসহ এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। শুধু বাড়েইনি, বরং এই বাড়া ছিল চরম অসহনীয়।
সাধারণ ভোক্তাদের এ সময়ে আয় না বাড়লেও বাড়তি দাম দিয়ে নিত্যপণ্য কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেকে ধারকর্জ করে জীবন চালাচ্ছেন। অনেকে ক্ষুদ্র সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সরকারের আগের মেয়াদে মানুষের কাছে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার বিষয়টিই সবচেয়ে বড় ইস্যু ছিল। বর্তমান সরকার এ মেয়াদে ক্ষমতায় এসেই জিনিসপত্রের দাম সহনীয় করার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এক মাস ধরে সরকারের বাণিজ্য, কৃষি, অর্থ ও খাদ্য মন্ত্রণালয় গলদঘর্ম হয়ে পণ্যের দাম কমানোর বিষয়ে দফায় দফায় যৌথ সভা করছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুরো ব্যাংকিং খাতে টাকার প্রবাহে লাগাম টেনেছে। সুদের হার বাড়িয়ে দিয়ে টাকা ব্যাংকে ঢোকানোর নীতি বাস্তবায়ন করছে। এতে অন্য সব খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও মূল্যস্ফীতি কতটা সহনীয় হবে, এ ব্যাপারে কমবেশি সবাই হতাশা প্রকাশ করেছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী আসছে রমজান মাসে চাল, চিনি, ভোজ্যতেল, খেজুরের দাম সহনীয় রাখতে শুল্ককর কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর নির্দেশনা মেনে এসব পণ্যের শুল্ককর কমানো হচ্ছে।
অথচ বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে কমেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সূচকে দেখা গেছে, গত জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন খাবারের গড় দাম অনেক কমেছে, যা গত ৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত জানুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম অনেক নিম্নমুখী হয়েছে। দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোতে ফসলটির মাড়াই বেড়েছে। তাতে বিশ্ববাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। আলোচ্য মাসে ভুট্টা ব্যাপক দর হারিয়েছে। গত জানুয়ারিতে সারা বিশ্বে মাংসের দাম আরও কমেছে। বিশ্বে পণ্যের বাম্পার ফলন হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে ধরনা দিয়ে দাম কমাতে বিভিন্ন সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছেন। সরকার কয়েকটি পণ্যের দাম ঠিক করে দিলেও তাঁরা তা মানছেন না। দেখা গেছে, চিনি, ডিম, ভোজ্যতেল, মাংসের দাম ঠিক করে দেওয়ার পরও তাঁরা তাঁদের ঠিক করা দামেই বিক্রি করে চলেছেন পণ্য। ভোক্তা-অধিকার অধিদপ্তর বাজারে বাজারে গিয়ে কয়েকজনকে ধরে জরিমানা করার মধ্যেই সীমিত থাকছে। এতে সত্যিকার অর্থে বাজার সহনীয় হচ্ছে না।
রমজান শুরু হতে মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাকি। সরকারের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বাজার নিয়ন্ত্রণের ঘোষণার পরও বাজারে এর প্রভাব সামান্যই। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে ভোক্তাদের সঙ্গে কথা হলে, তাঁরা বলেন, সরকারের গতানুগতিক পদক্ষেপ চলতে থাকলে বাজার সহনীয় হবে না। এখানে শুল্কছাড়ের বিষয়টির সুফল নিয়ে শুল্ক বিভাগকে নজরদারি করতে হবে। অতিমুনাফার কর দেয় কি না তা আয়কর বিভাগকে দেখতে হবে। কত টাকায় পণ্য এলসি খুলে, কত টাকা ঘোষণা দিয়ে পণ্য ছাড়িয়েছে, ওই পণ্য কত বিক্রি করেছে–কত মুনাফা করেছে ইত্যাদি দালিলিক তথ্য পর্যালোচনা করে ধরতে হবে। নাহলে বাজারে এর কার্যকর প্রভাব পড়বে না।