রাজধানীবাসীকে যানজটের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে ছয়টি মেট্রোরেল প্রকল্পের একটি চালু করেছে সরকার। আংশিক খুলে দেওয়া হয়েছে একটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েও। কিন্তু বিপুল খরচে নির্মিত এই দুই যোগাযোগ অবকাঠামো চালুর পরও যানজট পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি।
২০১৫ সালের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) অনুযায়ী, ঢাকায় দৈনিক ট্রিপ হয় প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ। গত ৯ বছরে তা বেড়ে ৪ কোটি ছাড়িয়েছে। একজন যাত্রী যানবাহনে উঠে গন্তব্যে পৌঁছানোকে একটি ট্রিপ ধরা হয়। মেট্রোরেলে এখন আড়াই লাখ যাত্রী যাতায়াত করে। সে হিসাবে আসা-যাওয়া মিলে মেট্রোরেলে ট্রিপ হয় ৫ লাখ। আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ট্রিপ হয় ৫৪ হাজারের মতো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেট্রোরেলের আরও পাঁচটি লাইন চালু হলেও সব মিলিয়ে ঢাকার ১৫ শতাংশ যাত্রী মেট্রোরেলের আওতায় আসবে। বাকি ৮৫ শতাংশ যাত্রীকে বাস, ব্যক্তিগত গাড়িসহ অন্যান্য যানবাহনে চলাচল করতে হবে। ফলে সড়কে শৃঙ্খলা না ফেরালে যানজট নিরসনের কোনো আশা নেই।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, যানজট কমানোর জন্য নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এতে অর্থ লাগবে না। ছোট গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রকল্পের জন্য গাড়ি বা ঋণে গাড়ি দেওয়ার মতো সুবিধা বন্ধ করতে হবে। নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে মোটরসাইকেল।
হাতিরঝিলে চক্রাকার বাসের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, হাতিরঝিলে বাস চলছে, সেখানে কোনো পুলিশ নেই। এটা সফল হয়েছে। গুলশানেও আছে। অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈজ্ঞানিক বাস রুট পারমিট দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
মেট্রোরেলে কতটুকু সুবিধা এসেছে
রাজধানীতে চালু হওয়া একমাত্র মেট্রোরেলটি সকাল ৭টা ১০ মিনিট থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলে। পর্যায়ক্রমে মেট্রোরেলটির চলাচলের সময় আরও ৩ ঘণ্টা বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এমআরটি-৬ পুরোদমে চালুর পর এই রুটে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা যাবে। প্রতিদিন যাতায়াত করবে ৬ লাখের বেশি মানুষ।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, এখন মেট্রোরেলে প্রতিদিন আড়াই লাখ যাত্রী চলাচল করছে। যে দূরত্বে যাত্রী চলাচল করছে, তাতে সময় বাঁচছে ২ ঘণ্টা। এতে করে এখন ৫ লাখ কর্মঘণ্টা সাশ্রয় হচ্ছে। আর টাকার হিসাবে দিনে প্রায় ৫ কোটি টাকা, যা মাসে দাঁড়াবে ১৫০ কোটি।
এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, মেট্রোরেলের হেডওয়ে কমাতে হবে। তবে শুধু মেট্রোরেল দিয়ে ঢাকায় সামগ্রিক যানজট কমানো কখনোই সম্ভব না। নগর পরিবহনের উন্নতি করতে হবে। ফুটপাত হকারমুক্ত করতে হবে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কি সুফল দিচ্ছে
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটির আংশিক (ফার্মগেট পর্যন্ত) খুলে দেওয়া হয়েছে যান চলাচলের জন্য। এক্সপ্রেসওয়েটি উদ্বোধনের পর এক মাসের গাড়ি চলাচলের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলাচল করা মোট গাড়ির ৯৯ শতাংশ ব্যক্তিগত। আর এক মাসে ব্যক্তিগত গাড়ি বা প্রাইভেট কার চলাচল করেছে ৮ লাখ। আর দিনে গড়ে ২৭ হাজার।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, যদি প্রতি গাড়িতে ২ জন থাকে, তাহলে ট্রিপ হয় ৫৪ হাজার। ঢাকায় গড় ট্রিপ ৯ কিলোমিটার ধরা হয়। এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য ১১ কিলোমিটার। কর্মঘণ্টা আসে ৮১ হাজার। আর প্রতি ট্রিপে ৪০০ টাকা করে ধরলে ১ কোটি ৬২ লাখ টাকা সাশ্রয় হবে। তিনি বলেন, ২০১৪ সালে গবেষণার সময় তাঁরা প্রাইভেট কার ট্রিপে ৩৭৮ টাকা করে ধরেছিলেন। সময়ের সঙ্গে সেটি এখন ৪০০ করে ধরা হয়েছে।
ফ্লাইওভারের মুখেও যানজট
ঢাকায় গাড়ির গতি বাড়াতে নেওয়া আরেক বড় প্রকল্প মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার। ২০১৩ সালের অক্টোবরে এটি খুলে দেওয়া হয়। ২ হাজার ১০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই ফ্লাইওভার যানজট নিরসনে পুরোটাই অকার্যকর। এই ফ্লাইওভারে সায়েদাবাদ থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত প্রায় সারা দিনই যানজট লেগে থাকে।
অন্যদিকে ১ হাজার ২১৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভারটি খুলে দেওয়া হয় ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে। এটিও ওই পথে যানজট কমাতে পারছে না। মগবাজার ও বাংলামোটর এলাকায় এখনো যানজট লেগেই থাকে।
জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ফ্লাইওভার দুটি সিটি করপোরেশনের অধীনে। তারা এই বিষয়ে ভালো বলতে পারবে।