এক আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর বেইলি রোডের গ্রিনকজি কটেজ ভবনের নানা দুর্বলতা বেরিয়ে আসছে। ভবন মালিক ও রেস্টুরেন্টগুলোর স্বত্বাধিকারীরা অগ্নিনিরাপত্তার মৌলিক নির্দেশনাগুলোর কোনো তোয়াক্কাই করেনি।
দ্বিতীয় দিনের মাথায় নতুন করে সামনে এসেছে ভবনটির সন্দেহজনক দুটি পাইপলাইন। যা তিতাস গ্যাসের অবৈধ লাইন হতে পারে-এমন শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। ফায়ার সার্ভিসও লাইন দুটোকে সন্দেহের চোখে দেখছে। যার লিকেজ থেকেও ভয়াবহ এ আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।
এ ব্যপারে তিতাস গ্যাসকে চিঠি দিয়ে পাইপলাইন দুটির বিষয়ে জানতে চাইবে ফায়ার সার্ভিস। শনিবার সরেজমিন গিয়ে পাইপলাইন দুটোর সন্ধান মিলেছে।
গ্রিনকজি কটেজে গিয়ে এবং ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দক্ষিণমুখী ভবনে ঢুকতেই হাতের ডান পাশের দেওয়ালের মধ্যে একটি পাইপলাইন রয়েছে। যা অনেকটাই গ্যাস লাইনের মতো। পাইপটির কিছু অংশ দৃশ্যমান।
আরেকটি লাইন ভবনে ঢুকতে হাতের বাম পাশে। যেটির শুরু পশ্চিম দিকের আরেকটি বহুতল ভবন ও গ্রিনকজি কটেজের মধ্যবর্তী স্থানে। সেই পাইপলাইনটি বাইরে থেকে দেওয়ালের ভেতরে ঢুকে গেছে। এটিও তিতাস গ্যাসের অবৈধ লাইন হতে পারে।
আগুনের সম্ভাব্য উৎসগুলোর মধ্যে এ দুটি লাইনকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি। এর পাশাপাশি আগুনের উৎসস্থল নিচতলার চা-চুমুক রেস্টুরেন্টে কোনো এসি ছিল কিনা, সেখানে অতিরিক্ত গ্যাসের উপস্থিতি ছিল কিনা-এ বিষয়গুলোও কমিটি খতিয়ে দেখছে। আগুন লাগার পরেই এর উৎসস্থলে একটি বিকট শব্দ হয়েছে।
এখন পর্যন্ত তদন্তসংশ্লিষ্টদের ধারণা, সেখানে একটি বিস্ফোরণ হয়েছে। বিস্ফোরণটি গ্যাস সিলিন্ডার নাকি অন্য কোথাও থেকে হয়েছে-তা নিয়েও কাজ করছে তদন্ত কমিটি। এসবের বাইরে পুরো ভবনের অগ্নিনিরাপত্তায় ত্রুটি এবং অবহেলার বিষয়গুলোও উঠে আসবে তাদের প্রতিবেদনে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) এবং তদন্ত কমিটির প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ভবনের পাইপলাইন দুটি আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়নি। এ কারণে নজরে আসার পরই আমরা তিতাস গ্যাসকে এ বিষয়ে লিখিতভাবে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করছি, তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ বিষয়ে সঠিক প্রতিবেদন দেবে। তদন্তে আমরা এ বিষয়গুলো নিয়ে আসব।
অপরদিকে তিতাস বলছে, ১৯৭২ সালে ভবনটিতে একটি বৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছিল। পরে সেখানে নতুন ভবন হলে শুরুতে সংযোগ নেওয়া হয়নি, হস্তান্তরও করা হয়নি। পরে গ্যাস সংযোগটি উপরের ছাদে নেওয়া হয়। সেখানেই এটির ব্যবহার ছিল।
তবে ছাদের কোথায় ব্যবহার হয়েছে, সেটি নিরাপদ ছিল কিনা, নিয়ম অনুযায়ী হয়েছে কিনা-সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে জানাতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।
তিতাসের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘বৈধ সংযোগটি রাইজার থেকে বের হয়ে উপরে চলে গেছে। ভবনটির অন্য কোনো ফ্লোরে সেটি ব্যবহার হয়নি। তবে স্টিলের পাইপে আরও একটি পুরাতন সংযোগ সেখানে রয়েছে। হাফ ইঞ্চি জিআই পাইপের সংযোগটি প্লাগ দেওয়া অবস্থায় রয়েছে। তবে এটি তিতাসের সংযোগ কিনা তা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। কারণ দ্বিতীয় কোনো লাইনের অনুমোদন নেই।’
বেইলি রোডের ঘটনায় তিতাসের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেবে আজ। তদন্ত কমিটির প্রধান তিতাস গ্যাসের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বৈধ লাইনটি ভবনের বাইরে দিয়ে ছাদের উপরে চলে গেছে। সেখানে হয়তো তারা সেটি দিয়ে রান্না করত। তবে আমাদের লাইন ঠিক আছে। এখান থেকে আগুনের উৎপত্তিস্থলে গ্যাস যায়নি।
তিনি আরও বলেন, ভবনের লোকজন জানিয়েছেন-নতুন ভবন হওয়ার পর পুরোনো লাইনটি ভবনে নেওয়া হয়নি। তবে যেহেতু সংযোগটি বৈধ, সে কারণে ওখানকার দারোয়ান-পিয়নরা মিলে লাইনটি টেনে ছাদে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। তবে আমাদের চোখের দেখায় কোনো অবৈধ সংযোগ ছিল না।
এদিকে ভবনটিতে আগুন নেভানোর তৎপরতা শুরুতে বিলম্বের অভিযোগ করছেন অনেকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও শেয়ার করে সেখানেও ফায়ার সার্ভিসের সমালোচনা চলছে।
অনেকেই বলছেন, সংস্থাটি ঘটনাস্থলে আসতে দেরি করেছে বিধায় আগুন বেশি ছড়িয়েছে। তবে ফায়ার সার্ভিস বলছে ভিন্নকথা।
তারা বলছে, সংবাদ প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম ইউনিট সিদ্দিকবাজার ফায়ার স্টেশন থেকে রওয়ানা হয়েছে। তবে রাস্তায় কোথাও কোথাও তাদের গাড়ি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। তবুও দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসে তারা কাজ শুরু করেছেন। এখানে চেষ্টার কোনো ঘাটতি ছিল না।
তাছাড়া ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ভবনে উপস্থিত জনতা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। এ কারণে শুরুতেই আগুন নেভানো যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (ঢাকা) মো. আনোয়ারুল হক যুগান্তরকে বলেন, আগুন লাগার সংবাদ পেয়েই ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে রওয়ানা হয়েছে। ঢাকা শহরের যানজটের বাস্তবতায় এর আগে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
আগুন লাগার পর ভবন ও দোকান কর্তৃপক্ষের প্রাথমিকভাবে যে ভূমিকা রাখার কথা তারা তা রাখতে পারেনি। তারা ফায়ার এক্সটিংগুইশারটি খালি জায়গায় বাতাসের দিকে মেরেছে। অথচ আগুনের উৎপত্তিস্থলে এটি মারলে হয়তো শুরুতেই আগুন নিভে যেত। অদক্ষ হাতে ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহার আগুন নেভাতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। এছাড়া উপরে যেহেতু দাহ্য পদার্থ ছিল, সে কারণে এটি খুব দ্রুতই অন্যান্য ফ্লোরেও ছড়িয়েছে।
এদিকে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিনকজি কটেজ নামের ভবনে আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানীর রমনা মডেল থানায় একটি মামলা হয়েছে। শুক্রবার রাতে পুলিশ বাদী হয়ে এ মামলা করে।
তারা এ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। এ ঘটনায় গ্রেফতার চারজনের ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। পাশাপাশি বিস্ফোরক পরিদপ্তরসহ অন্যান্য সংস্থাও এ ঘটনায় তদন্ত করছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন, অগ্নিনিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। এতে উঠে আসছে নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কথা। তদারক সংস্থাগুলোর অবহেলার জন্য তাদের শাস্তির দাবি জোরালো হচ্ছে।
‘রেগুলেটরি বোর্ডের শাস্তি হয় না’ : শনিবার বেইলি রোডে পুড়ে যাওয়া ভবন পরিদর্শনে এসে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, যারা রেগুলেটরি বোর্ডে আছে তাদের কোনো শাস্তি হয় না। তারা শুধু নোটিশ দেন। নোটিশ বড় ব্যবস্থা নয়, আপনারা কেন সেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করলেন না, সেটা হচ্ছে প্রশ্ন?
তিনি বলেন, যেসব রেগুলেটরি বোর্ড এ ভবনে ব্যবসার অনুমতি দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিক। এ ধরনের ঘটনা আবার ঘটুক এটা আমরা চাই না। যার ত্রুটি থাকবে তার বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে। সেটা যদি কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে হয় তবে ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে, আর যদি কোনো সংস্থার বিরুদ্ধে হয় তবে সেটা সংস্থার বিরুদ্ধে। আপনারা সবকিছু বাণিজ্যিকিকরণ করবেন আর সেটার মাধ্যমে মানুষের জীবন চলে যাবে, এটা হতে পারে না। যে রেগুলেটরি বোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ সরকার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। এখানে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়েছে, কাস্টমারদেরও ক্ষতি হয়েছে। তাদের জীবন চলে গেছে। আমাদের শত কোটি টাকা এখানে নষ্ট হয়েছে। যারা রেগুলেটরি বোর্ডে আছে তাদের কোনো শাস্তি হয় না।
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি বলেন, আমরা বিডা এবং এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে আলোচনা করে মালিক সমিতিসহ বিভিন্ন স্টেক হোল্ডাররা বিভিন্ন মার্কেট পরিদর্শন করলাম। সেখানে আমরা দেখলাম কোথাও বিদ্যুতে সমস্যা, কোথাও ফায়ার সমস্যা। এখন ফায়ার সেফটিতে যারা কাজ করেন তারা এক সময় ফায়ার ব্রিগেডে কাজ করতেন। তারা ফার্মগুলো খুলেছেন। এখন একেক মার্কেটে গিয়ে তারা বলছেন ৩/৪/৫ কোটি টাকা লাগবে ফায়ার সেফটির জন্য।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত বড় অঙ্কের টাকা আমরা কোথায় পাব? সরকার বলেছে ফায়ার সেফটির জন্য বিদেশ থেকে যত মালামাল আসবে সেগুলো ট্যাক্স ফ্রি থাকবে। এটা দেশের মানুষের জন্য করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা যখন বিভিন্ন সংস্থার কাছে যাচ্ছি, তখন তারা সেই কাজটি করছে না।
নোটিশ দিয়ে দায় এড়াতে পারে না-এফবিসিসিআই : ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই গ্রিনকজি কটেজে ৪৬ জনের প্রাণহানির জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আমিন হেলালীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল শনিবার ভবনটি পরিদর্শন করে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
আমিন হেলালী বলেন, আইন সরকারের হাতে, আমরা আইন মেনে ব্যবসা করব। ব্যবসা করতে অনেক কাগজপত্র লাগে। কেউ যদি আইন না মেনে ব্যবসা করে, তা করার সুযোগ নেই। যাদের দেখার দায়িত্ব ছিল, তারা কী করলেন?
এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, অগ্নিকাণ্ডের জন্য শুধু একতরফাভাবে ব্যবসায়ীদের দায়ী করলে হবে না। এ এলাকা দেখার জন্য রেগুলেটর প্রতিষ্ঠানের অনেক ইন্সপেক্টর (পরিদর্শক) আছে, তারা কী করেছেন? আমি মনে করি, তাদের গাফিলতি আছে। দুর্ঘটনার পর তারা (নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো) এখন একতরফাভাবে ব্যবসায়ীদের দোষারোপ করছেন। শুধু নোটিশ দিয়ে তারা দায় এড়াতে পারেন না। দুর্ঘটনার আগেই আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ তাদের ছিল। সেটি না করে তারা তখন উদাসীন ছিলেন। ব্যবসায়ী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে যারা যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেন তিনি।
দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে-ডিএমপি : বেইলি রোডের গ্রিনকজি কটেজে মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যাদের দায় থাকবে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। শনিবার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এ কথা বলেন ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস্ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. ফারুক হোসেন।
তিনি বলেন, বৃহস্পতিবারের এ আগুনে এখন পর্যন্ত ৪৬ জন মারা গেছেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা চারজনকে আটক করেছি। অবহেলাজনিত এ দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে কাদের দায় আছে, ভবন মালিকের, নাকি রেস্টুরেন্ট মালিক ও ম্যানেজারের দায়-সেগুলো আমরা বিশ্লেষণ করছি।
পাশাপাশি কোথায় কোথায় অবহেলা আছে, কোন কোন সংস্থার এখানে কাজ করার কথা ছিল, তারা কীভাবে কাজ করেছে-সব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ চলছে। এরপর যাদের বিরুদ্ধে দায় পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। এ ঘটনায় বিভিন্ন সংস্থার গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে যাদের বিরুদ্ধে দায় পাওয়া যাবে তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।