কাজে নেই দেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ। অর্থাৎ তারা কোনো কাজ করছেন না। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী দেশে বেকার সংখ্যা ২৩ লাখ ৫০ হাজার মানুষ। কিন্তু শ্রমশক্তির বাইরে আছেন ৪ কোটি ৭৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষ। তারা কর্মে নিয়োজিত নন, আবার বেকার হিসাবেও বিবেচিত হন না।
এই শ্রেণির বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বলা হয় শ্রমশক্তির বাইরে। এ দুই অংশ মিলে দাঁড়ায় ৪ কোটি ৯৭ লাখ ১০ হাজার বা প্রায় ৫ কোটি। এর মধ্যে নারীদের বড় অংশই রয়েছে শ্রমের বাইরে। তবে কাজের বাইরে থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, যা শঙ্কার সৃষ্টি করছে-এমন অভিমত বিশেষজ্ঞদের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কোয়ার্টারলি লেবার ফোর্স সার্ভে-২০২৩-এর চতুর্থ কোয়ার্টারের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে সংস্থাটি। ‘শ্রমশক্তি জরিপের মাধ্যমে শ্রমবাজার তথ্যের উন্নয়ন’ শিরোনামের প্রকল্পের মাধমে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক আজিজা রহমান যুগান্তরকে বলেন, পুরো জনগোষ্ঠীকে বেকার বলা যাবে না। কেননা আইএলও-এর গাইডলাইন অনুযায়ী যারা ৭ দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টাও কোনো কাজ করেনি, কিন্তু কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন; পাশাপাশি বিগত ৩০ দিনে বেতন/মজুরি বা মুনাফার বিনিময়ে কোনো না কোনো কাজ খুঁজেছেন-তাদেরকেই বেকার বলা হয়। আর শ্রমশক্তির বাইরে থাকা অর্থ হচ্ছে-যারা সাধারণত ছাত্র, অসুস্থ, বয়স্ক, কাজ করতে অক্ষম, অবসরপ্রাপ্ত এবং কর্মে নিয়োজিত নন বা নিয়োজিত হতে অনিচ্ছুক-এমন গৃহিণীরা। এজন্য দুটিকে এক করে বেকার বলা যায় না। তবে কর্মের বাইরে আছেন, এটা বলা যায়। এ সংখ্যাটা অনেক বেশি। এটি কমিয়ে আনতে কাজ করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, শ্রমশক্তির বাইরে থাকা মানুষের মধ্যে যারা কাজেও নেই, শিক্ষায়ও নেই আবার প্রশিক্ষণেও নেই, তারাও আছেন। এছাড়া ভবঘুরে, পিতামাতার আদরের সন্তান, অলস শ্রেণির মানুষও রয়েছে এ অংশে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সোমবার যুগান্তরকে বলেন, আইএলও-এর আরেকটি সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যারা কর্মে নেই, শিক্ষায় নেই এবং প্রশিক্ষণেও নেই অথচ কর্মক্ষম, তারাই শ্রমশক্তির বাইরের জনশক্তি। এটি আগে ব্যবহার হলেও ইদানীং কেন যেন ব্যবহার করা হয় না। তবে এ ৪ কোটি ৭৩ লাখ মানুষের মধ্যে এদের সংখ্যাই বেশি। এছাড়া নারীদের মধ্যে একটি বড় অংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ ২০-২৫ বছরের মধ্যে অনেকের বিয়ে হয়ে সন্তান জন্ম দেন। ফলে বয়সভিত্তিক শ্রমশক্তি হিসাব করলে দেখা যাবে এ বয়সে এসে হঠাৎ করেই শ্রমশক্তিতে থাকা নারীর সংখ্যা অনেক কমে যাবে। এজন্য ২০১৬-১৭ সালের দিকে ডে-কেয়ার সেন্টার আইনের খসড়া তৈরিতে সহায়তা দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু সেটি মন্ত্রিপরিষদে পড়ে ছিল, এখন কী অবস্থা জানি না। এটি হলেও নারীদের বিশেষ করে শহরের নারীদের কর্মে অংশগ্রহণের হার বাড়ত।
তিনি আরও বলেন, শ্রমশক্তির বাইরে যারা আছেন, তাদের মধ্যে একটি অংশ তরুণ জনগোষ্ঠী। যারা কাজ খুঁজে হয়রান হয়ে জরিপের সময় হয়তো কাজ খুঁজেনি বা প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ না পাওয়ায় হতাশ হয়ে বসে আছেন, এদের আনইউটিলাইজড (অব্যবহৃত) জনগোষ্ঠী বলা হয়। সব মিলিয়ে শ্রমশক্তির বাইরে থাকা মানুষের একটি বড় অংশকে গ্রামার অনুযায়ী বেকার বলা না গেলেও আক্ষরিক অর্থে তারাও বেকার।
বিবিএস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিন মাসের হিসাবে দেশে বেকার সংখ্যা বেড়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বেকার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩ লাখ ৫০ হাজারে। এর মধ্যে পুরুষ ১৫ লাখ ৭০ হাজার এবং নারী ৭ লাখ ৮০ হাজার। আর ২০২২ সালের একই সময়ে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ সাড়ে ১৬ লাখ এবং নারী বেকার ৬ লাখ ৬০ হাজার। তবে ২০২৩ সালের বার্ষিক হিসাবে সাময়িকভাবে বেকার সংখ্যা ২০২২ সালের তুলনায় কমবে বলে মনে করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ২০২৩ সালের বার্ষিক হিসাবে বেকার দাঁড়াতে পারে ২৪ লাখ ৭০ হাজার। ২০২২ সালের চূড়ান্ত হিসাবে এ সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৮০ হাজার। শতাংশ অনুযায়ী অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর-তিন মাসে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ২০ শতাংশ, যা এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। তবে ২০২৩ সালের সাময়িক হিসাবে বার্ষিক বেকার ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ, যা ২০২২ সালের চূড়ান্ত হিসাবে ছিল ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
বিবিএস-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছরের চতুর্থ কেয়ার্টারের হিসাব অনুযায়ী শ্রমশক্তির বাইরে থাকা মোট জনগোষ্ঠী হলো ৪ কোটি ৭৩ লাখ ৬০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ১ কোটি ১৮ লাখ ১০ হাজার এবং নারী ৩ কোটি ৫৫ লাখ ৫০ হাজার। ২০২২ সালের একই কোয়ার্টারের হিসাব অনুযায়ী শ্রমশক্তির বাইরে ছিল ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ছিল ১ কোটি ১৭ লাখ ৪০ হাজার এবং নারী ৩ কোটি ৪১ লাখ ৩০ হাজার। বার্ষিক হিসাবেও এই সংখ্যা বাড়ছে। ২০২৩ সালের সাময়িক হিসাবে শ্রমশক্তির বাইরে থাকা জনগোষ্ঠী হচ্ছে ৪ কোটি ৭১ লাখ ৮০ হাজার। ২০২২ সালের চূড়ান্ত হিসাবে এই সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৬৩ লাখ ২০ হাজার।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশের ১৫ বছর থেকে এর ঊর্ধ্বের জনগণের মধ্যে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণকারীদের হারও কমছে। ২০২৩ সালের চতুর্থ কোয়ার্টারে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণকারীর হার ৬০ দশমিক ৮০ শতাংশ। যেটি ২০২২ সালের চতুর্থ কোয়ার্টারে ছিল ৬১ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০২৩ সালের সাময়িক হিসাবে বার্ষিক শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণকারীর হার ৬০ দশমিক ৮৯ শতাংশ, যা ২০২২ সালের চূড়ান্ত হিসাবে ছিল ৬১ দশমিক ২০ শতাংশ।
এদিকে দেশে বাড়ছে যুব শ্রমশক্তি। ২০২৩ সালের চতুর্থ কোয়ার্টারে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৬২ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ১ কোটি ৩১ লাখ ৮০ হাজার এবং নারী ১ কোটি ৩১ লাখ। ২০২২ সালের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫৯ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ১ কোটি ৩৩ লাখ ৩০ হাজার এবং নারী ১ কোটি ২৯ লাখ ৪০ হাজার। তবে বার্ষিক হিসাবে সামান্য কমতে পারে এ সংখ্যা। ২০২৩ সালের সাময়িক হিসাবে বার্ষিক সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ২ কোটি ৬৭ লাখ ৪০ হাজার এবং ২০২২ চূড়ান্ত হিসাবে ছিল ২ কোটি ৬৮ লাখ ২০ হাজার।
প্রসঙ্গত, গত বছরের শেষ প্রান্তিকের হিসাবে দেশে মোট শ্রমশক্তি আছে ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৬০ হাজার। ২০২২ সালের একই সময়ে যা ছিলো ৭ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার।