বিমান এয়ারবাস না কিনে বোয়িংয়ের ড্রিমলাইনার কিনলে বছরে ৫৮ থেকে ৬০ কোটি টাকা বেশি লাভ করতে পারবে। কারণ, বোয়িংয়ের ড্রিমলাইনার অপারেশনে জ্বালানি খরচ ৬ শতাংশ কম। আর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কম ৩০ শতাংশ। অপরদিকে বিমান যদি এয়ারবাস ক্রয় করে, তাহলে ২০ বছরে ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লোকসান গুনতে হবে। এসব তথ্য উল্লেখ করে বোয়িং বিমানের কাছে ৪টি সুপরিসর যাত্রীবাহী ড্রিমলাইনার এবং ২টি কার্গো এয়ারক্রাফট বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে। বিমান এ প্রস্তাবে রাজি থাকলে শাহজালালের ক্যাটাগরি-১-এর বাধা কাটাতে সহায়তা দেবে বোয়িং। তারা বলেছেন, এফএএ-এর ক্যাটাগরি-১ পেতে নিজেদের খরচে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করবে। তাদের দেওয়া বিক্রয় প্রস্তাবেও এ শর্ত দেওয়া আছে।
মঙ্গলবার ঢাকায় একটি হোটেলে বোয়িং কমার্শিয়াল এয়ারপ্লেন কোম্পানির ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের শীর্ষ কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন। বোয়িংয়ের ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট রায়ান উয়ার, ইউরেশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশের বিপণন বিভাগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অশ্বিন নাইডু এবং বোয়িংয়ের বিক্রয় পরিচালক কান্তি ভুবনাগিরি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। বোয়িং কর্মকর্তারা একই সঙ্গে নিশ্চিত হতে চান-প্রতিদ্বন্দ্বী প্লেন মেকার ইউরোপের এয়ারবাসের প্রস্তাবও যেন স্বচ্ছতার সঙ্গে মূল্যায়ন করা হয়। তারা মনে করে, এয়ারবাসের প্রস্তাব যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হলে বোয়িংয়ের দেওয়া প্রস্তাবই আর্থিক ও কারিগরিভাবে নির্ভরযোগ্য হবে। এমনকি বিমানের প্রয়োজন অনুযায়ী এয়ারবাসের আগেই বোয়িং তাদের এয়ারক্রাফট সরবরাহ করতে পারবে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে বিমানের সঙ্গে বোয়িংয়ের বর্তমান ও অতীত সম্পর্ক, কোম্পানির বিভিন্ন দিকের পাশাপাশি এয়ারবাসের প্রস্তাবের বিষয়টিসহ দুই উড়োজাহাজ নির্মাতার তুলনামূলক আলোচনা হয়। এছাড়া বোয়িংয়ের নিরাপত্তা বিষয়ে বৈশ্বিক উদ্বেগ, দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হলে খুচরা যন্ত্রাংশ পেতে অসুবিধা-শঙ্কা, অর্থায়নসহ বিভিন্ন দিক উঠে আসে। বিমানের বর্তমান বাণিজ্যিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এয়ারবাসের চেয়ে বোয়িং যে বাণিজ্যিকভাবে সফল ও নিরাপদ, সেটার ওপর বেশ জোর দিয়ে তথ্যপ্রমাণাদি তুলে ধরেন তারা। একই সঙ্গে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তারা একটি বিষয়ের ওপর বেশি জোর দিয়েছেন, সেটা হলো বিমান যেন এয়ারবাসের আর্থিক প্রস্তাব স্বচ্ছতার সঙ্গেই প্রকাশ করে। পাশাপাশি বিমান যেন বোয়িংয়ের প্রস্তাবও যথাযথ প্রক্রিয়ায় মূল্যায়ন করে।
ঢাকা সফররত বোয়িংয়ের এসব শীর্ষ কর্মকর্তার দাবি, অন্য কোনো নির্মাতার চেয়ে তাদের উড়োজাহাজের দাম কম এবং পুরো প্রস্তাব আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী। তাদের এ প্রস্তাবে রাজি থাকলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বিমান লাভবান হবে।
তারা আরও বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে তাদের দেওয়া প্রস্তাবে চারটি যাত্রীবাহী এবং দুটি কার্গো উড়োজাহাজের কথা বলা হয়েছে। এ প্রস্তাবনা নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বিমান বাংলাদেশ। তবে সাম্প্রতিক সফরে তারা সরকারের কাছ থেকে মূল্যায়নের আশ্বাস পাওয়ার দাবি করেছেন। তারা ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিমান মন্ত্রণালয় ও বিমানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং তাদের দেওয়া প্রস্তাবটি পুরোপুরি মূল্যায়নের অনুরোধ করেছেন বলে জানান।
বিশ্বজুড়ে ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে বিমান কেন নতুন করে ৭৮৭ কেনার প্রস্তাব বিবেচনা করবে-এ প্রশ্নের জবাবে বোয়িং কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী সম্প্রতি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের নিরাপত্তার উদ্বেগের খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিমানকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলেছিলেন। আমরা এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সাড়া দিয়েছি, সব ধরনের প্রমাণ দিয়েছি। আমরা খুশি হব, সিয়াটল থেকে একজন বিশেষজ্ঞকে ঢাকায় এনে বিষয়গুলো নিশ্চিত করে নিতে। তারা জানান, বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের যাত্রা শুরু হয় ২০২১ সালের দিকে। উৎপাদনের সময় তারা কিছু বিষয় দেখতে পান। ১৮ থেকে ২৪ মাস এফএএ-এর সঙ্গে এ নিয়ে কাজ করে কোম্পানিটি। উড়োজাহাজগুলো নিরাপদ রয়েছে কি না, এর জন্য তারা কঠোর প্রকৌশলগত মূল্যায়ন করেন। আগে তৈরি প্রতিটি উড়োজাহাজ পরীক্ষা করে দেখেন বোয়িং কর্মীরা। যে কারণে সেই সময়ে তাদের নতুন উড়োজাহাজ উৎপাদন প্রক্রিয়া ধীর হয়ে আসে। তারা জানান, এ মডেলের উড়োজাহাজ ১৩ বছর ধরে সার্ভিসে আছে। এর মধ্যে এটি ৮৫০ মিলিয়ন যাত্রী বহন করেছে।
সূচনা বক্তব্যে রায়ান ওয়ার দাবি করেন, প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির তুলনায় বোয়িংয়ের প্লেনের দাম অনেক কম এবং জ্বালানিসাশ্রয়ী। এতে বিমানই লাভবান হবে। কারণ, এ মুহূর্তে বোয়িংয়ের পাশাপাশি অন্য কোনো নির্মাতার প্লেন যদি বিমান নেয়, সেটা মিক্সড ফ্লিট হিসাবে খুব সুবিধাজনক হবে না। এমনকি আগামী ২০ বছরের পরিকল্পনায় মোট ব্যয় বেড়ে যাবে অতিরিক্ত দেড়শ মিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে বিমান আরও একটি উড়োজাহাজ কিনতে পারবে।
বিমান বোয়িংনির্ভর হয়ে পড়লে যদি কোনো সময় দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়, তাহলে কি বোয়িং খুচরা যন্ত্রাংশ দেওয়া বন্ধ করে দেবে-এমন এক প্রশ্নের জবাবে রায়ান বলেন, কখনোই নয়। এখন তিনটি দেশের সঙ্গে আমাদের এ রকম অবস্থা বিরাজমান। এগুলো হলো রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়া। আমার মনে হয় না বাংলাদেশের সঙ্গে এমন কোনো সমস্যা হবে। কারণ, দুদেশের মধ্যে একটি ভালো সম্পর্ক রয়েছে।