জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিষ্ঠা এবং সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে লাল-সবুজের পতাকাকে ৩৫ বছর ধরে বিশ্বের বুকে সমুন্নত রেখেছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। বিরোধপূর্ণ বিভিন্ন দেশে শান্তি এবং নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় তারা অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে কাজ করছেন। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী হিসাবে নীল হেলমেটে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তারা শত্রæদের বিরুদ্ধে লড়ছেন। শান্তির প্রশ্নে তারা উন্নত মমশীর। প্রতিবছরের মতো আজও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী বিশ্বের সব দেশের শান্তিরক্ষীদের অসামান্য অবদানকে এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে।
১৯৮৮ সালে ইউএন ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভেশন গ্রুপ (ইউনিমগ) মিশনে মাত্র ১৫ জন সেনা পর্যবেক্ষক পাঠানোর মাধ্যমে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এরপর থেকে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী বেশ সুনাম ও কৃতিত্বের সঙ্গে শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করে যাচ্ছে।
আইএসপিআর সূত্রে জানা গেছে, শান্তিরক্ষার ইতিহাসে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বিশ্বের ৪৩টি দেশ ও স্থানে, ৬৩টি জাতিসংঘ মিশন সফলতার সঙ্গে শেষ করেছে। বর্তমানে ১৩টি দেশে ৬ হাজার ৯২ জন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ও কার্যক্রমে নিয়োজিত আছে, যার মধ্যে রয়েছে ৪৯৩ জন নারী। শুরু থেকে এ পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের মোট ১৬৮ জন শান্তিরক্ষী শহিদ হয়েছেন। এ বছর ৩ জন আহত শান্তিরক্ষীকে সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে।
১৯৮৯ সালে নামিবিয়ায় মিশনের মাধ্যমে শান্তিরক্ষায় যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ পুলিশ। এরই মধ্যে পুলিশের প্রায় ২১ হাজার ৪৫৩ জন সদস্য বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে নারী শান্তিরক্ষী রয়েছেন এক হাজার ৮১০ জন। সংঘাত ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠায় তারা ব্যাপক প্রশংসা ও সুনাম কুড়িয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বর্তমানে ৩৬৪ জন সদস্য কাজ করছেন। এর মধ্যে নারী রয়েছেন ১২০ জন।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২৩টি দেশে মিশনে পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন পুলিশ সদস্যরা। বর্তমানে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, মালি, সাইপ্রাস, সাউথ সুদান, সেন্ট্রাল আফ্রিকা ও লিবিয়ায় বাংলাদেশ পুলিশের ১২০ জন নারীসহ ৩৬৪ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত আছেন। এ পর্যন্ত শান্তিরক্ষা মিশনে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ২৪ জন পুলিশ সদস্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। আহত হয়েছেন ১২ জন।
পুলিশ সদর দফতরের পুলিশ সুপার ইনামুল হক সাগর বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ হাইতির ভূমিকম্প বিধ্বস্ত অসহায় মানুষের পাশে থেকে মানবিক সহায়তা দিয়েছে, আবার আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পুলিশি সেবা প্রদান, পুলিশের প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখেছে, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে।
জানা গেছে, বিশ্বের সংঘাতময় অঞ্চলগুলোতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালে জন্ম হয় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের। ওই বছরের ২৯ মে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ বিরতি পর্যবেক্ষণের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের সিনাই অঞ্চলে প্রথম জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষীদের মোতায়েন করা হয়েছিল। বিশ্বের ১২০টিরও বেশি দেশের সেনা, পুলিশ ও বেসামরিক নাগরিকরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করেছেন। যাদের মধ্যে অনেকে দায়িত্বপালনকালে নিহত হয়েছেন। বিভিন্ন দেশের শান্তিরক্ষীদের মহান আত্মত্যাগকে স্মরণ করে ২০০৩ সাল থেকে ২৯ মে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
কর্মসূচি: এবারও বাংলাদেশে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপিত করা হচ্ছে। সকালে শান্তিরক্ষীদের স্মরণে ‘শান্তিরক্ষী দৌড়-২০২৪’-এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবসের কর্মসূচি শুরু হবে এবং ১১টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শহিদ শান্তিরক্ষীদের নিকটাত্মীয় ও আহত শান্তিরক্ষীদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে। এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনার, বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী, তিন বাহিনী প্রধান, সংসদ-সদস্য, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও), পুলিশের মহাপরিদর্শক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বসহ ঊর্ধ্বতন সামরিক ও অসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
দিবসের মর্যাদা ও গুরুত্ব তুলে ধরে জাতীয় পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হবে। বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং বাংলাদেশে বেতারে বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।