সংগ্রহ মূল্যের ওপর ১ শতাংশ উৎসে কর কর্তনের নির্দেশনার পর থেকে সরকারি গুদামে চাল বিক্রিতে আগ্রহ হারিয়েছিলেন চালকল মালিকরা। এতে সরকারের বোরো মৌসুমের চাল সংগ্রহ কার্যক্রম এক প্রকার স্থবির হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সংগ্রহ কার্যক্রমের আওতায় ধান, গম ও চাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে সংগ্রহ মূল্য পরিশোধে উৎসে কর কর্তন এক বছর পর্যন্ত প্রযোজ্য হবে না বলে জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে গতকাল রবিবার এনবিআরের কর নীতি উইং থেকে এই মতামত জানানো হয়। তবে চালের জট ছাড়ালেও চলতি বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ ধান সংগ্রহের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংগ্রহ অভিযানের দুমাস পেরিয়ে গেলেও লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও এখন পর্যন্ত পূরণ হয়নি। সিদ্ধ ও আতপ চাল সংগ্রহের চিত্র কিছুটা সন্তোষজনক হলেও লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক পিছিয়ে ধান সংগ্রহ।
কৃষকরা বলছেন, সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে হলে মানতে হয় বেশ কিছু নিয়ম-কানুন। খাদ্য গুদামে ধান বিক্রিতে দালালদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগও রয়েছে। তবে খাদ্য অধিদপ্তর বলছে, সংগ্রহ অভিযান শেষ হতে যে সময় বাকি আছে, তাতে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়ে যাবে। অভিযান সফল করতে তারা নানা কার্যক্রম নিয়েছেন বলেও জানান অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এবারের বোরো মৌসুমের ধান-চাল সংগ্রহ শুরু হয় চলতি বছরের ৭ মে থেকে। ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ মে. টন। এ ছাড়া সিদ্ধ চাল ১১ লাখ মে. টন ও আতপ চাল ১ লাখ মে. টন। তবে সংগ্রহ অভিযানের দুই মাস পেরোলেও লক্ষ্যমাত্রার ধারে-কাছেও নেই ধান-চাল সংগ্রহ। গতকাল পর্যন্ত সারাদেশে ধান সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৪৮ হাজার ২৫৭ মে. টন, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ১১ লাখ মে. টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সিদ্ধ চাল সংগ্রহ হয়েছে ৬ লাখ ৭ হাজার ৭৭৭ মে. টন, যা মাত্র ৫৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া ১ লাখ মে. টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে গতকাল পর্যন্ত আতপ চালের সংগ্রহ ৪৪ হাজার ৬৯২ মে. টন, যা ৪৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
এর আগে, চলতি বছরের ২৯ মে সংগ্রহ মূল্য পরিশোধের ওপর উৎসে কর কর্তন বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর। পরবর্তী সময় ১ জুলাই উৎসে কর কর্তন বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে খাদ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়।
তবে উৎসে কর কর্তনের সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়ে বোরো মৌসুমের অভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহে। সরকারি গুদামে চাল বিক্রি বন্ধ করে দেন মিল মালিকরা। পরবর্তী সময় বিষয়টি অবগত করে এনবিআরকে চিঠি দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। চিঠির জবাবে গতকাল এনবিআর থেকে বলা হয়, উৎসে কর বিধিমালা-২০২৪-এর বিধি ০৩ মোতাবেক খাদ্য বিভাগ কর্তৃক অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য কার্যক্রমের আওতায় ধান, গম ও চাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে সংগ্রহ মূল্য পরিশোধের সময় ১ জুলাই, ২০২৪ থেকে ৩০ জুন, ২০২৫ পর্যন্ত উৎসে কর কর্তন প্রযোজ্য হবে না।
জানা যায়, এবার প্রতি কেজি বোরো ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৩২ টাকা, সিদ্ধ চাল ৪৫ টাকা এবং আতপ চাল ৪৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে কৃষকদের দাবি, ধান বিক্রিতে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে যে শর্ত দেওয়া হয়, তাতে সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করা জটিল হয়ে যায় তাদের জন্য।
সংগ্রহ অভিযানের নিয়ম অনুযায়ী, ফসল ওঠার পর গ্রামের কৃষকদের উপজেলা খাদ্যগুদামে গিয়ে ধান দিয়ে আসতে হয়। এ সময় ধানের আর্দ্রতা থাকতে হয় ১৪ শতাংশ। সংকট তৈরি হয় এই আর্দ্রতা নিয়ে। নির্ধারিত আর্দ্রতার বেশি হলে ধান ফেরত দেওয়া হয়। তখন গাড়ি ভাড়া করে গুদাম থেকে ধান বাড়িতে আনতে হয়। এই জটিলতার কারণে সরকারি গুদামে ধান বিক্রিতে আগ্রহ হারচ্ছেন কৃষকরা।
সরকারি গুদামে ধান-চাল বিক্রি করায় দালালদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ করেন সাতক্ষীরার কৃষক দেবনাথ। তিনি বলেন, গুদামে ধান-চাল বিক্রিতে টাকা পেতে দেরি হয়। তা ছাড়া দালালরা ভালো ধান নিয়ে খারাপ ধান বিক্রি করে দেয়। এতে আমরা ভালো দাম পাই না। এ ছাড়া সরকারি গুদামে ধান বিক্রিতে কৃষকের পক্ষ থেকে আবেদন করা হলেও তাতে সাড়া পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ তাদের।
তবে ধান সংগ্রহ অভিযান সফল করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, এখনো যে সময় বাকি আছে তাতে আমরা লক্ষ্যমাত্র পূরণ করতে পারব। ধান সংগ্রহ কম হওয়ায় গত ১ জুলাই থেকে আমরা কৃষকের অ্যাপের বাইরে আগে আসলে আগে নেওয়ার ভিত্তিতে তালিকাভুক্ত কৃষকদের ম্যানুয়ালি সরকারি গুদামে ধান বিক্রয়ের সুযোগ দিচ্ছি। এটি বাস্তবায়নের পর ধান সংগ্রহের হার বেড়েছে।