২৩ জুন ২০২৫, সোমবার, ০৪:৪৪:১৯ পূর্বাহ্ন
মধ্যপ্রাচ্যে বড় ‘জুয়া’ খেলছেন ট্রাম্প?
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০৬-২০২৫
মধ্যপ্রাচ্যে বড় ‘জুয়া’ খেলছেন ট্রাম্প?

‘শান্তির দূত’ হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান উত্তেজনাপূর্ণ সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রকে জড়িয়ে ফেলার জন্য একটি নাটকীয় পদক্ষেপ নিয়েছেন। 


ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনা তো দূরের কথা, ট্রাম্প এখন এমন একটি অঞ্চলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যেটা আরও বড় যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে; এমন একটি যুদ্ধ যেখানে আমেরিকা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে।


ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় আমেরিকা হামলা চালিয়েছে বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষণা করার মাত্র দুই ঘণ্টা পর হোয়াইট হাউস থেকে জাতির উদ্দেশ্যে টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, এই অভিযানটি ছিল একটি অসাধারণ সাফল্য।


তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, তার এই পদক্ষেপ আরও স্থায়ী শান্তির দরজা খুলে দেবে, যেখানে ইরানের আর পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। 


ইরান বলেছে, তাদের শক্তিশালী ফোরদো পারমাণবিক কেন্দ্রে স্থাপনার সামান্য ক্ষতি হয়েছে। তবে সময়ই বলে দেবে কোন পক্ষ সঠিক।


যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথকে পাশে নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে সতর্ক করে বলেন, যদি তারা তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি বাদ না দেয়, তাহলে ভবিষ্যতে এমন হামলার মুখোমুখি হবে যা অনেক ভয়াবহ।


ট্রাম্প বলেন, অনেক টার্গেট এখনও বাকি আছে, এবং আমেরিকা গতি, নির্ভুলতা এবং দক্ষতার সঙ্গে সেদিকেও যাবে। 


মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ ধরনের হুমকি সত্ত্বেও ইরানে আমেরিকার অব্যাহত সামরিক সম্পৃক্ততা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ওই অঞ্চল এবং বিশ্বের জন্য সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি বয়ে আনতে পারে।


জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, আমেরিকা সংঘাত বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার ফলে মধ্যপ্রাচ্য একটি নিয়ন্ত্রণহীন বিশৃঙ্খলার চক্রে পড়ে যেতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন অঞ্চলটি ইতোমধ্যে সেই পরিস্থিতির দ্বারপ্রান্তে।


যদি ইরান প্রতিশোধ নেয়, যেমন মার্কিন হামলা হলে ঘটবে বলে সতর্ক করেছিলেন আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি, সেক্ষেত্রে আমেরিকাও জবাব দিতে বাধ্য হতে পারে।


দুই সপ্তাহ দুই দিনে পরিণত


চলতি সপ্তাহের শুরুতে ট্রাম্প যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, ইরানকে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে, সেটা প্রেসিডেন্টকে এমন একটা অবস্থায় ফেলে দেয় যেখান থেকে তার ফিরে আসা ছিলো কঠিন। ইরানও যে হুমকি দিচ্ছিল, সেটাও তাকে একই অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল।


এভাবেই যুদ্ধ শুরু হয় এবং যারা এর সাথে সংশ্লিষ্ট, যুদ্ধটা তাদের কল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বৃহস্পতিবার ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানিদের দুই সপ্তাহের সময়সীমা দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা যা প্রত্যাশা করা হয়েছিল তারচেয়েও কমে আসে মাত্র দু’দিনে। শনিবার রাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন, তিনি পদক্ষেপ নিয়েছেন।


দুই সপ্তাহ ধরে আলোচনা কি কেবলই ভান?


এই সপ্তাহ শেষে ইরানিদের একটা মিথ্যা নিরাপত্তার অনুভূতিতে প্রলুব্ধ করার একটি প্রচেষ্টা? নাকি পর্দার আড়ালে ট্রাম্পের মনোনীত দূত স্টিভ উইটকফের নেতৃত্বে শান্তি আলোচনা ভেস্তে গেছে?


হামলার পরপরই তাৎক্ষণিকভাবে এর ফলাফল খুব কমই জানা যায়। কিন্তু ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট এবং টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভাষণে শান্তির দ্বার উন্মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। তবে এটি হয়তো অতিরিক্ত আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ ইসরায়েল ইরানের সামরিক সক্ষমতা দুর্বল করতে উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা চালালেও আয়াতুল্লাহর হাতে এখনও অনেক অস্ত্র রয়েছে।




তবে পরিস্থিতি দ্রুত জটিল হয়েও উঠতে পারে। এখন অপেক্ষার পালা শুরু। ইরান তার তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার প্রতিক্রিয়া কীভাবে দেখাবে, যার মধ্যে ফোরদোও রয়েছে, যেটিকে তার পারমাণবিক কর্মসূচির রাজকীয় মুকুট হিসেবে দেখা হয়?


ট্রাম্প আশা করছেন, মার্কিন হামলা ইরানকে আলোচনার টেবিলে আরও বেশি ছাড় দিতে বাধ্য করবে। কিন্তু এটির সম্ভাবনা খুব কম, কারণ যে দেশটি ইসরায়েলি হামলার সময় আলোচনায় রাজি নয়, তারা আমেরিকান বোমা পড়ার সময় আরও আগ্রহী হবে—এমন ভাবা কঠিন।


আর যদিও ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, মার্কিন আক্রমণ ছিল একটি একক ও সফল অভিযান। কিন্তু যদি বাস্তবে তা না হয়, তাহলে আবারও আক্রমণ করার জন্য চাপ বাড়বে অথবা প্রেসিডেন্টকে ন্যূনতম একটা সামরিক লাভের জন্য গুরুতর রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে হবে।


শান্তির দূত প্রেসিডেন্ট পাল্টা রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকিতে


সেই ঝুঁকির মধ্যে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় রাজনৈতিক উদ্বেগের মতো বিষয়ও আছে। ইরানের ওপর মার্কিন হামলার সম্ভাবনা ইতোমধ্যে কেবল ডেমোক্র্যাটদের কাছ থেকে নয়, ট্রাম্পের নিজস্ব ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ আন্দোলনের ভেতর থেকেও তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।


জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সময় প্রেসিডেন্টের অস্বাভাবিকভাবে তার তিনজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাকে পাশে রাখা সম্ভবত তার দলের মধ্যে ঐক্য প্রদর্শনের একটি প্রচেষ্টা ছিল। বিশেষ করে ভ্যান্স, যিনি বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের আরও সংযত পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে কথা বলেছেন, সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে দাবি করেছেন, ট্রাম্প এখনও একজন অনাক্রমণবাদী এবং তার সমর্থকদের তাকে ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দেওয়া উচিত।


যদি এই আক্রমণ শুধু একবারের জন্য হয়ে থাকে, তাহলে ট্রাম্প হয়তো তার সমর্থকগোষ্ঠীর মধ্যে খুব সহজেই বিভক্তি দূর করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু যদি এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আরও বৃহত্তর সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট তার দলের ভেতর থেকেই প্রতিরোধের মুখে পড়তে পারেন।


শনিবারের আক্রমণ প্রেসিডেন্টের জন্য এমন একটি আগ্রাসী পদক্ষেপ ছিল, যিনি তার প্রথম মেয়াদে কোনও নতুন যুদ্ধ শুরু না করার গর্ব করেছিলেন। গত বছর নির্বাচনী প্রচারে বিদেশি সংঘাতে দেশকে জড়ানো পূর্বসূরিদের বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে সমালোচনা করেছিলেন। ট্রাম্প তার পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু এখান থেকে এটি কোথায় যাবে তা পুরোপুরি তার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই।


শেয়ার করুন