০৪ জুলাই ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:৩৯:০০ পূর্বাহ্ন
ইরান-সংঘাত যেভাবে গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিল
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৭-২০২৫
ইরান-সংঘাত যেভাবে গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিল

যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ  সমর্থনেই মূলত ইরানে হামলা চালায় যুদ্ধবাজ ইসরাইল। তবে পরের দিকে এই আগ্রাসন প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কূটনীতির মাধ্যমে একটি যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায়।


গত ১৩ জুন শুরু হওয়া ইসরাইলি আগ্রাসনে ইরানের সামরিক, পারমাণবিক ও আবাসিক এলাকা ১২ দিন ধরে লক্ষ্যবস্তু হয়। অব্যাহত হামলার দশম দিনে অর্থাৎ ২২ জুন এতে সরাসরি যোগ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ওইদিন রাতভর ইরানের নাতাঞ্জ, ফরদো ও ইসফাহান-এই তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়।


এর জবাবে ইরানের ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর অ্যারোস্পেস ফোর্স ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ-৩’ এর অংশ হিসেবে ২২ দফার পাল্টা অভিযানে প্রায় সাড়ে ৪শ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরাইল অধিকৃত অঞ্চলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়।


অন্যদিকে মার্কিন বিমান হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান কাতারের আল-উদেইদ মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। এতে পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে বড় মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতেও বেশ ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়।এ হামলার জেরে ২৪ জুন ট্রাম্প তড়িঘড়ি করে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের ঘোষণা দেন।


ইরানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের যৌথ আগ্রাসনের বহুমাত্রিকতা বিশ্লেষণে রুশ একাডেমি অব সায়েন্সেস-এর ইন্সটিটিউট অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের গবেষক লানা রাওয়ান্দি-ফাদায়ি বার্তা সংস্থা মেহের-এর সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন।


তার কাছে, ইসরাইল কেন ইরানে হামলা চালালো বলে মনে করেন-এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এটি নৈতিকতা, আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনীতির সম্পূর্ণ অবজ্ঞা। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মার্কিন শক্তির ওপর নির্ভর করে শুধু ইরান নয়, গোটা অঞ্চলের ‘অবাঞ্ছিত’ সরকার ও গোষ্ঠী দমন করতে চান।


তার মতে, এই ‘সম্রাটের নতুন পোশাক’ দৃশ্যপট দেখে রীতিমত অবাক হতে হয়, কীভাবে তথাকথিত সভ্য রাষ্ট্রগুলো এটিকে ‘আত্মরক্ষা’ ও ‘অবশ্যকতা’-র নামে বৈধতা দেয়।


এদিকে গাজায় নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও অপরাধের মধ্যেই ইসরাইল লেবাননের হিজবুল্লাহ, প্রো-ইরানি গোষ্ঠী ও সিরিয়ায় ইসলামপন্থিদের ক্ষমতায় আনতে সহায়তা করেছে। গাজায় সমস্ত ঘরবাড়ি ধ্বংস ও হামাসকে দুর্বল করার পর তারা ইরানে সরকার পতনের দিকে এগোয়। তেহরানের আবাসিক এলাকাগুলোও বোমা হামলার শিকার হয়।


এই আক্রমণের নেপথ্যে ছিল ইসরাইল ও মার্কিন-সমর্থিত রেজা শাহ পাহলভিকে ক্ষমতায় আনার প্রচেষ্টা। ইরানে যার জনপ্রিয়তা অত্যন্ত সীমিত। মানবাধিকার বা গণতন্ত্র নয়, মূল লক্ষ্য ছিল একটি ‘বন্ধুসুলভ’ সরকার প্রতিষ্ঠা করা। যেন ইসরাইল প্রতিবেশীদের নিয়ে যা খুশি করতে পারে। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে।


যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?


এদিকে ইসরাইলি আগ্রাসন শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় অংশ ইসরাইলকে সমর্থন দিয়েছে। জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্জ তো সরাসরি বলেছেন, ইসরাইল পশ্চিমা বিশ্বের ‘নোংরা কাজ’ সেরে দিচ্ছে।


তবে রাশিয়া ও চীন দৃঢ়ভাবে ইসরাইলি আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছে। আর্মেনিয়া, তুরস্ক, পাকিস্তানসহ ইরানের প্রতিবেশীরা তেহরানকে সমর্থন করেছে। সিরিয়ার কিছু সাংবাদিক, ইসলামপন্থিদের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়ে ইসরাইলের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন। তবে কাতার একটি পরিপক্ব ও কৌশলগত ভূমিকা নিয়েছে, যা এই যুদ্ধবিরতিতে সহায়ক ছিল।


যুক্তরাষ্ট্র কবে, কীভাবে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়?


লানা রাওয়ান্দি বলেন, ধারণা করা হয়, ২২ জুন ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর সময়েই যুক্তরাষ্ট্র এতে যুক্ত হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই মূল পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল—হয়তো দশ বছর আগেই ইসরাইলের সঙ্গে যৌথভাবে এ অভিযানের পরিকল্পণা করা হয়েছিল।


ইসরাইল মূলত মার্কিন অস্ত্র, অর্থ, গোয়েন্দা তথ্য ও কূটনৈতিক কভার ব্যবহার করেছে, যা তাদের দীর্ঘদিনের জোটসুলভ আচরণ।


এই সংঘাতে নতুন বৈশ্বিক মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে কি?


ফাদায়ি বলেন, এখনই বলাটা তাড়াহুড়ো হবে। পশ্চিমারা ইসরাইলের পক্ষে, রাশিয়া-চীন ইরানের পক্ষে। তবে উভয় জোটই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চায়, বিশেষ করে ইউক্রেন সংকটের প্রেক্ষিতে।


এ বিষয়ে পুতিন দৃঢ়ভাবে বলেছেন, ইরান এই সংঘাতে আক্রান্ত পক্ষ এবং যুদ্ধবিরতির আগে তার অবস্থান ইঙ্গিত দেয় যে, রাশিয়া সক্রিয় হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এটাই হয়তো ট্রাম্পকে যুদ্ধবিরতির দিকে ঠেলে দেয়।


যুক্তরাষ্ট্রের হামলা যুদ্ধের গতি বদলেছে কি?


রুশ বিশ্লেষকের মতে, পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলা ছিল মূলত সাজানো নাটক।পশ্চিমা মিডিয়ায় তা রীতিমতো নায়কোচিতভাবে উপস্থাপিত হয়। তবে বাস্তবে এর সামরিক-রাজনৈতিক প্রভাব তেমন ছিল না। এটি ছিল হয়তো একটি থিয়েট্রিক্যাল ‘গ্র্যান্ড ফিনালে’, যা সংঘাত গরম হয়ে ওঠার আগে একটি সুন্দর ‘সমাপ্তি’ এনে দেয়।


শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলো কেন?


রাওয়ান্দি বলেন, হামলা-পালটা হামলায় উভয়পক্ষই প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। ইসরাইল মার্কিন সহায়তায় আকাশ প্রতিরক্ষা বজায় রাখলেও, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিহত করা যাচ্ছিল না। তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের ঘাটতি ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছিল।


এর মাঝে ইরানের হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি ও ইয়েমেনি হুথিদের যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চুক্তি বাতিল যুদ্ধকে আরও বিস্তৃত করে ফেলতে পারত। এই ঝুঁকিই ট্রাম্প প্রশাসনকে একটি দ্রুত সমাপ্তি চাওয়ার দিকে ঠেলে দেয়।


এছাড়া রাশিয়া, চীন, কাতার, তুরস্ক, আজারবাইজানসহ একাধিক দেশ কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে।


রাশিয়া কীভাবে মধ্যস্থতার ভূমিকা নিয়েছে?


এ প্রশ্নের জবাবে রুশ বিশ্লেষক বলেন, পুতিন যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেন। তবে জোর করে নয়—সরকারিভাবে অনুরোধ পেলেই উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তুতি ছিল। যুদ্ধের শুরু থেকেই রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রেই বেলুসভ ও অন্য কর্মকর্তারা ইরানকে সমর্থন ও সমবেদনা জানান।


রাশিয়ার কূটনৈতিক ও নীতিনির্ধারকদের দৃঢ় বিবৃতিই হয়তো নেতানিয়াহুর আগ্রাসী মনোভাব কিছুটা ঠান্ডা করে। কারণ ইরানে রাশিয়ার শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক প্রকল্প রয়েছে—সেখানে তাদের স্বার্থও জড়িয়ে আছে।


পরিশেষে ফাদায়ি বলেন, ইসরাইল-ইরান যুদ্ধ ছিল একটি গভীর ঝুঁকিপূর্ণ জুয়া, যেখানে পশ্চিমাদের সমর্থনে ইসরাইল একতরফা আগ্রাসন চালায়। কিন্তু ইরানের প্রতিরোধ, আন্তর্জাতিক বিরোধিতা ও কূটনৈতিক চাপ এই যুদ্ধকে একটি অনিশ্চিত যুদ্ধবিরতিতে পরিণত করে। পরিস্থিতি এখনো উত্তেজনাপূর্ণ এবং ভবিষ্যৎ সংঘাতের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।_


শেয়ার করুন