১৯ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ০৪:২৩:৩১ অপরাহ্ন
সীমান্তের চোরাচালান রুট স্বর্ণের খনি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-১১-২০২২
সীমান্তের চোরাচালান রুট স্বর্ণের খনি

দেশের সীমান্তবর্তী ১২ জেলার অর্ধশতাধিক চোরাচালান রুট যেন সোনার খনিতে পরিণত হয়েছে। এসব স্থানের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন উদ্ধার হচ্ছে স্বর্ণ। গত দুই মাসে রুটগুলো থেকে অর্ধশত কোটি টাকার স্বর্ণ উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। পাশপাশি গ্রেফতার করা হয়েছে বাহকদের। গ্রেফতার ব্যক্তিদের দাবি, স্বর্ণগুলো বিভিন্ন বিমানবন্দর হয়ে দেশে আসে। এরপর ভারতে পাচারের উদ্দেশে নেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে বিমানবন্দরে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্মতৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, স্বর্ণ পাচারের সীমান্তঘেঁষা রুটগুলোর মধ্যে চুয়াডাঙ্গায় রয়েছে তিনটি। এগুলো হলো-কার্পাসডাঙ্গা, দর্শনা ও জীবননগর। সাতক্ষীরা লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী ৬টি-ভাদিয়ালী, কালীগঞ্জ, শেরপুর, ভোমরা, নোংলা ও কৈখালী। যশোরের পাঁচটি পয়েন্ট দিয়ে স্বর্ণ পাচার করা হয়। এ ছাড়া রাজশাহীর সোনাইকান্দি, হরিপুর, কাশিডাঙ্গা, আলাইপুর, বাগা, মুক্তারপুর ও চড়ঘাট; চাঁপাইনবাবগঞ্জের কিরণগঞ্জ, ভোলাহাট ও দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট, ফুলবাড়ী, হিলি, কামালপুর ও বিরল; কুড়িগ্রামের রৌমারী ও ফুলবাড়ী এবং লালমনিরহাটের বুড়িরহাট, শ্রীরামপুর ও দহগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ভারতে স্বর্ণ পাচার হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সীমান্ত এলাকা দিয়ে স্বর্ণ পাচারে কৃষক, দিনমজুর, ট্রাক-লরির চালক, খালাসি, রাখাল ও জেলেদের ব্যবহার করা হচ্ছে। টিফিন বক্স, মৌসুমি ফলের ঝুড়ি, সবজি ও শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে রেখে স্বর্ণ পাচার করা হচ্ছে। স্বর্ণ চোরাকারবারিরা পাচারের সময় বাংলাদেশ ও ভারতের মোবাইল সিম ব্যবহার করে। কথাবার্তা চলে এসএমএসের মাধ্যমে। আকাশপথে স্বর্ণ আসার পর বাস ও ট্রেনে সীমান্তের জেলাগুলোতে পৌঁছে যায়।

এ বিষয়ে বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমরা কেবল পাচারের সময় স্বর্ণ আটক করি। পাশাপাশি পাচারকারীদের গ্রেফতার করি। আমরা মামলার তদন্ত করি না। প্রাথমিকভাবে যেসব তথ্য পাই তা সঙ্গে সঙ্গেই প্রেস রিলিজ দিয়ে জানিয়ে দিই। এরপর আর বেশিকিছু জানার সুযোগ থাকে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুই দেশের সীমান্তরক্ষীরা স্বর্ণ পাচারের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে নজরদারি করছে। যেসব পয়েন্ট দিয়ে স্বর্ণ পাচার হচ্ছে সেখানে নজরদারি ও টহল বাড়ানো হয়েছে বলে তিনি জানান।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চোরাকারবারিরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে স্বর্ণ এনে বাংলাদেশ ও ভারতের বাজারে সরবরাহ করছে। এ কাজে তারা নিজস্ব বাহক যেমন ব্যবহার করছে, তেমনি টাকার টোপে কখনো পাইলট, কখনো ক্রু, কখনো বিমানবালাকেও কাজে লাগাচ্ছে। তাছাড়া বিমানের ক্লিনার, ট্রলিম্যান এমনকি প্রকৌশলীরাও এই চক্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে স্বর্ণ পাচারে জড়িয়ে পড়ছে। যাত্রীবেশি বাহকের সঙ্গে থাকা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ইলেকট্রিক মোটর, দেহের বিভিন্ন অংশ, ট্রলির ওপরের হ্যান্ডেল ও মানিব্যাগে করে স্বর্ণ পাচারের ঘটনা ঘটছে। এছাড়া রোগী সেজে হুইল চেয়ারে, ঊরুতে অ্যাংকলেট বেঁধে, জুতার মধ্যে, বেল্ট দিয়ে কোমরবন্ধনীর ভেতরে, শার্টের কলারের ভেতরে, স্যান্ডেলের সঙ্গে, সাবান কেসে, সাউন্ড বক্সের অ্যাডাপটরে, বিভিন্ন ধরনের খাদ্য বা ওষুধের কৌটা, প্যান্টের নিচে শর্টসের ভেতর, ল্যাপটপের ব্যাটারির ভেতর, মানিব্যাগে ও গলায় চেইনের সঙ্গে ঝুলিয়ে লকেট হিসেবেও আনা হচ্ছে সোনার বার। এরপর নানা কৌশলে হাত বদল হয়।

বিজিবি জানায়, ৭ সেপ্টেম্বর যশোরের পুটখালী সীমান্ত থেকে ১ কেজি ১৬৬ গ্রাম ওজনের ১০টি স্বর্ণের বারসহ দুইজনকে আটক করা হয়। এর তিনদিন পর একই জেলার গোগা সীমান্ত থেকে দুই কোটি ৫৩ লাখ তিরাশি হাজার ছয়শ একত্রিশ টাকা মূল্যের ৩ কেজি ৪৯৮ গ্রাম ওজনের ৩০টি স্বর্ণের বারসহ একজনকে আটক করা হয়। এ ঘটনার পাঁচদিন পর বিজিবির চুয়াডাঙ্গা ব্যাটালিয়নের অভিযানে ছয় কোটি ৬০ লাখ ৩৫ হাজার ৭৪০ টাকা মূল্যের ৯ কেজি ৮৬০ গ্রাম ওজনের ৫৮টি স্বর্ণের বারসহ এক পাচারকারীকে আটক করে বিজিবি। এর দুদিন পর যশোরের পুটখালী সীমান্ত থেকে ২ কোটি টাকা মূল্যের ২০টি স্বর্ণের বারসহ একজনকে আটক করা হয়। ২০ সেপ্টেম্বর যশোরের শার্শা উপজেলার গোগা সীমান্ত থেকে এক কোটি ২৭ লাখ ৪৮ হাজার টাকা মূল্যের ১৫টি স্বর্ণের বারসহ এক পাচারকারীকে আটক করা হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর একই জেলার রুদ্রপুর সীমান্ত থেকে ৮৯ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫০ টাকা মূল্যের এক কেজি ২৩৩ গ্রাম ওজনের ১০টি স্বর্ণের বারসহ সাকিব হোসেন নামে একজনকে গ্রেফতার করে বিজিবি। ১৪ অক্টোবর শার্শা সীমান্ত থেকে তিন কোটি ৪৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা মূল্যের ৪৩টি স্বর্ণের বার উদ্ধার উদ্ধার করা হলেও পাচারকারীকে আটক করা সম্ভব হয়নি। ১৬ অক্টোবর সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে ৫০৬ গ্রাম ওজনের ৪টি স্বর্ণের বারসহ শামিমুল ইসলাম নামে এক পাচারকারী বিজিবির হাতে আটক হন। ১৮ অক্টোবর ঝিকরগাছা সীমান্ত থেকে ১০ কোটি টাকা মূল্যের সাড়ে ১২ কেজি ওজনের ১০৬টি স্বর্ণের বারসহ একজনকে গ্রেফতার করা হয়। ২২ অক্টোবর ঝিনাইদহের যাদবপুর সীমান্ত থেকে ৩ কেজি ৭২০ গ্রাম ওজনের ৩২টি স্বর্ণের বার এবং ২৭ অক্টোবর বেনাপোল পোর্ট থানার গাজীপুর গণকবর এলাকা থেকে ১ কেজি ২শ গ্রাম স্বর্ণ বার উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ শনিবার ৯টি স্বর্ণের বারসহ মো. কাউছার আলীকে আটক করে বিজিবি। গেল দুই মাসে অন্য সীমান্ত স্পটগুলোতে আরও প্রায় ২০ কোটি টাকার স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মঞ্জুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনো গাফিলতি নেই। ব্যাপক নিরাপত্তা বেস্টনী ভেদ করে কীভাবে স্বর্ণগুলো বিমানবন্দর থেকে বের হচ্ছে তা গভীরভাবে খতিয়ে না দেখে মন্তব্য করা যাবে না।

শেয়ার করুন