তিনমাস আগে পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) দায়িত্ব নেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বাংলাদেশ পুলিশের ৩১তম আইজিপি। তার চাকরির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১১ জানুয়ারি। ফলে মাত্র সাড়ে তিনমাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে ৩২তম আইজিপি পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ। আগামীতে কে হচ্ছেন দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এ বাহিনীর প্রধান, তা নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। নতুন কোনো কর্মকর্তা এ পদে আসছেন নাকি বর্তমান আইজিপিকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে মেয়াদ বাড়ানো হবে, তা নিয়ে চলছে আলোচনা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এ বছর অস্থির থাকতে পারে। রাজনৈতিক সহিংসতার আশঙ্কাও করছেন বিভিন্ন মহল। রাজনীতির মাঠের সহিংসতা মোকাবিলায় প্রধান ভূমিকা রাখে পুলিশ। ঠিক এমন সময়ে পুলিশপ্রধানের দায়িত্বে কে আসছেন, তা নিয়ে হিসাব-নিকাশ চলছে। চাপের মধ্যেও দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে সক্ষম এমন কর্মকর্তাকে দায়িত্বে রাখতে চাইছে সরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইজিপি হওয়ার দৌড়ে বর্তমান পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ বেশ কয়েকজন আলোচনায় রয়েছেন। তবে আইজিপি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের নজির না থাকায় বর্তমান আইজিপির মেয়াদ বাড়ানো হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সেক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা ও দক্ষতা বিবেচনায় নতুন আইজিপি পদে আসতে পারেন পুলিশ সদরদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মো. কামরুল আহসান। অথবা অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি এস এম রুহুল আমিন।
তবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে বর্তমান আইজিপির মেয়াদ বাড়ানোর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। যদি তাই হয়, সেক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনীতে নতুন রেকর্ড গড়বেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচন ও নানা ধরনের সংকট মোকাবিলায় দক্ষতার সঙ্গে ভূমিকা রাখতে পারবেন- এমন কর্মকর্তাই নতুন আইজিপি পদে নিয়োগ পাবেন। সার্বিক পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান আইজিপির চুক্তিভিত্তিক মেয়াদ বাড়ানোসহ যোগ্য ও দক্ষ কয়েকজনের নাম প্রস্তাব করে একটি ফাইল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে, আলোচনায় থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা সরকারের বিভিন্ন মহলে যোগাযোগও রাখছেন। দেশের ৩২তম পুলিশপ্রধান পদের জন্য শেষ মুহূর্তে চলছে দৌড়ঝাঁপ। তবে সরকার সংকট মোকাবিলায় দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতা দেখে নতুন আইজিপি নিয়োগের দিকে হাঁটতে পারে।
পুলিশ সদরদপ্তর সূত্র জানায়, আইজিপি পদে সুনির্দিষ্ট কোনো মেয়াদকাল নেই। সরকারি চাকরির বিধি অনুযায়ী ৫৯ বছর বয়স হলে অবসরে যান কর্মকর্তারা। আগামী ১১ জানুয়ারি সরকারি চাকরির বিধি অনুযায়ী ৫৯ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ায় বর্তমান আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের চাকরির মেয়াদ শেষ হবে। বিধি অনুযায়ী মাত্র তিন মাস ১১ দিন আইজিপি পদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
তবে বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ চারবছর সময় ধরে আইজিপি ছিলেন হাসান মাহমুদ খন্দকার। ২০১০ সালের ৩১ আগস্ট থেকে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
আইজিপি পদে আলোচনায় যারা
মো. কামরুল আহসান
৩২তম আইজিপি পদে নিয়োগের দৌড়ে আলোচনায় রয়েছেন পুলিশ সদরদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মো. কামরুল আহসান। ১৯৯১ সালে বিসিএস ১২তম ব্যাচের (পুলিশ) ক্যাডারে যোগদান করেন তিনি। প্রশিক্ষণ শেষে খাগড়াছড়ি জেলার সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে পদায়ন হয় তার। এরপর চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী সার্কেলের এএসপি হন কামরুল আহসান।
পরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি, শরীয়তপুর, চট্টগ্রাম ও যশোর জেলার পুলিশ সুপার, পুলিশ সদরদপ্তরের অ্যাডিশনাল ডিআইজি (সংস্থাপন) ও অ্যাডিশনাল ডিআইজি (ট্রেনিং) এবং রেলওয়ে রেঞ্জের ডিআইজি, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে গড়ে তোলা পুলিশের বিশেষায়িত শাখা অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
কামরুল আহসান জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে সিয়েরালিওন ও সুদানে ‘পুলিশ অ্যাডভাইজার’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মিশনগুলোতে দৃষ্টান্তমূলক অবদান রাখায় ‘জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা পদক’ লাভ করেন তিনি।
কামরুল আহসান ১৯৬৬ সালে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ইমামপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে (এমবিএ) স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
এস এম রুহুল আমিন
আইজিপি হওয়ার দৌড়ে নাম আসছে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে গড়ে তোলা পুলিশের বিশেষায়িত শাখা অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি এস এম রুহুল আমিন। তিনি বিসিএস ১২তম ব্যাচের পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তা। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার, সিলেট জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন রুহুল আমিন।
ঢাকায় সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার, চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি এবং রেলওয়ে পুলিশের ডিআইজি, বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের (বিএমপি) কমিশনার ও পুলিশ সদরদপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি (লজিস্টিকস অ্যান্ড অ্যাসেট অ্যাকুইজিশন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এ কর্মকর্তা। তিনি আইভরিকোস্ট, দক্ষিণ সুদানসহ বেশ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের হয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করেছেন।
এস এম রুহুল আমিন গোপালগঞ্জ জেলার সদর থানায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে স্নাতকসহ (সম্মান) স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন
চাকরির মেয়াদ শেষ হলেও আইজিপি পদে পুনরায় নিয়োগ পেতে পারেন বর্তমান আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। সেক্ষেত্রে তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে পারে সরকার। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন অষ্টম বিসিএস ব্যাচের পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। আগামী ১১ জানুয়ারি সরকারি চাকরির বিধি অনুযায়ী- তার ৫৯ বছর বয়স পূর্ণ হবে। ফলে চাকরির মেয়াদও শেষ হবে। বিধি অনুযায়ী মাত্র তিনমাস ১১ দিন আইজিপি পদে দায়িত্ব পালন করবেন তিনি।
এর আগে আবদুল্লাহ আল-মামুন র্যাবের মহাপরিচালক, সিআইডির প্রধান, অতিরিক্ত আইজিপিসহ (এইচআরএম) বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা অস্থিরতা ও সংকট মোকাবিলা করতে হবে আইজিপিকে। নতুন আইজিপি নিয়োগের ক্ষেত্রে এসব বিষয় আমলে নিচ্ছে সরকার। ফলে অতীতের সব নজির ভেঙে চুক্তিভিত্তিক মেয়াদ বাড়ানোর মাধ্যমে আবারও আইজিপি হতে পারেন তিনি।
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ১৯৬৪ সালের ১২ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার শ্রীহাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
এদিকে, পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নবম, ১০ম ও ১১তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে কোনো কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়নি। আবার ১৩ ও ১৪তম বিসিএসেও পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগ হয়নি। এতে বর্তমান আইজিপির পর জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে কোনো কর্মকর্তাকে আইজিপি পদে নিয়োগ করা নিয়েও কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা গেছে।
সেক্ষেত্রে বর্তমান আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দেড় বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারেন। তার মেয়াদকাল শেষে আইজিপি নিয়োগ পেতে পারেন পুলিশ সদরদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মো. কামরুল আহসান অথবা পুলিশের বিশেষায়িত শাখা অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি এস এম রুহুল আমিন। পাশাপাশি পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামও আইজিপি পদে আসতে পারে। তিনি ১৫তম বিসিএসের পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তা।