শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘আমাদের যারা গ্রাজুয়েট তারা যখন প্রার্থী হয়ে চাকরির জন্য ভাইভা দিতে যায় তখন চাকরিদাতার প্রত্যাশা ও চাকরি গ্রহিতার মধ্যে বিস্তর ফারাক থেকে যায়। দেখা যায়, আমার দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বড় ডিগ্রিধারীরা চাকরি পায় না। কিন্ত পাশের দেশের কম ডিগ্রিধারীরা চাকরি পেয়ে যায়। চাকরিদাতা কখনো কাউকে চাকরি দিয়ে শেখাবেন না, তিনি তৈরি মানুষ চান। এজন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের চাকরির জন্য প্রস্তুত করে তুলতে হবে। যেন চাকরিদাতা ও প্রার্থীর মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি হয়।’
আজ বৃহস্পতিবার (২ জুন) দুপুরে রাজশাহী নগরীর খড়খড়ি এলাকায় বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
শিক্ষামন্ত্রী দর্শন এবং সাহিত্য পড়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের যেন সাহিত্য ও দর্শন পড়ানো হয়। তার কারণ, সত্যিকার অর্থে যে বিশ্ববিদ্যালয় সেটির অর্থ থাকে না। সাহিত্য মানুষের মধ্যে যে বোধ সৃষ্টি করে তা যদি চর্চা করা না হয়, দর্শনের বোধ যদি না থাকে তাহলে সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়বে। প্রতিটি বিভাগে যদি সাহিত্য ও দর্শন পড়ানো হয় তাহলে আমার বিশ্বাস, তারা অনেক দূর এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। কারণ একজন মানুষের সাহিত্যের বোধ থাকা দরকার। আর দর্শন জানা থাকলে তা সত্যিকার অর্থে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে।’
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কোন বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সব সময় বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নামেই বিশ্ববিদ্যালয় করেছেন। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে তাঁর কন্যা অভিষ্ট লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। তার কল্যাণে উন্নয়ন পাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। গবেষণা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণা নিয়ে সব সময় উৎসাহ দিচ্ছি, বরাদ্দও দিচ্ছি। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা কাজে অনেক পিছিয়ে। তবে বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক গবেষণাগার আছে। কারণ, গবেষণায় এগিয়ে যেতেই হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মানে শুধু জ্ঞান চর্চা নয়, জ্ঞান সৃষ্টির কেন্দ্র। গবেষণা করলেই উদ্ভাবনী শক্তি বাড়বে। পাঠাগারগুলো অবশ্যই অনলাইনের আওতায় আনতে হবে। সারাবিশ্বের বড় বড় লাইব্রেরীর সাথে সংযোগ স্থাপনের সুযোগ থাকলে তা কাজে লাগানো উচিত।’
বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় হবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত বলে দীপু মনি বলেন, ‘আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অনেক ছবি দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। এখনো এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নির্মানাধীন। কিন্তু যখন পুরোপুরি নির্মাণ কাজ শেষ হবে আমি বিশ্বাস করি- এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু পড়তে নয়, অনেকে দেখতেও আসবে। কারণ বিশ্বমানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে যা যা করা দরকার সবই এখানে করা হচ্ছে। আমি শুনলাম, এখানে অডিটোরিয়াম করা হচ্ছে, জিমনেশিয়াম করা হচ্ছে, বিশাল খেলার মাঠ হচ্ছে। কারণ শিক্ষার সঙ্গে যদি এগুলো না থাকে তাহলে তা ফ্রুটফুল কাজ করবে না।’
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দিকে সবাইকে গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়ে দীপু মনি বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেন বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। যেমন- বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা, বিতর্ক ইত্যাদি। এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা আমরা বলছি। এজন্য বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে হবে। রোবটিং প্রতিযোগিতা এখন অনেক বেশি প্রয়োজন। অবশ্য বরেন্দ্র বিশ^বিদ্যালয়ে এটি আছে এবং এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি খুবই ভালো করছে। অনেক প্রতিযোগিতায় তারা অংশগ্রহণ করে বিজয় ছিনিয়ে আনছে। রোবটিং এর মাধ্যমে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কার্যক্রম শুরু হবে। এই রোবটিং চালানোর দক্ষতা আমাদেরকে অর্জন করতে হবে।’
শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তনের জন্য ইতোমধ্যেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে নতুন কারিকুলাম তৈরী করা হচ্ছে উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমরা নতুন করে শিক্ষাক্রম তৈরী করছি। এটির জন্য বিভিন্ন ধরনের গবেষণার কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালে। নতুন শিক্ষাক্রম তৈরী করবার কাজ ২০১৯ সালে শুরু করেছি। গত সাড়ে ৩ বছরে আমরা এটিকে একটি জায়গায় নিয়ে এসেছি। ২০২৩ সাল থেকে প্রাথমিকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি আর মাধ্যমিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন এই শিক্ষাক্রম শুরু হবে। ২০২৪ সালে হবে প্রাথমিকে তৃতীয় ও চতুর্থ এবং মাধ্যমিকে অষ্টম-নবম আর ২০২৫ সালে প্রাথমিকে পঞ্চম এবং মাধ্যমিকে দশম শ্রেণির নতুন শিক্ষাক্রম চালু করবো। অর্থাৎ এই তিন বছর ধরে এই কারিকুলামকে রোল আউট করবো। নতুন এই শিক্ষাক্রমে মৌখিক যে সিদ্ধান্ত রয়েছে- সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দক্ষ, যোগ্য পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানবিক মানুষ গড়ে তুলবার জন্যে কাজ করে যাচ্ছি।’
ডা. দীপু মনি গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা লক্ষ্য স্থির করুন। আপনাদের মেধা, আপনাদের দক্ষতা-যোগ্যতা-শ্রম-অধ্যবসায় দিয়ে আপনারা লেগে থাকবেন। লেগে থাকলে সাফল্য আসবেই। খেয়াল রাখবেন, সেই সাফল্য যেন কখনো কোনো অসততার কলুষতার কালিমা লিপ্ত না হয়।’ তিনি সাফল্য পাওয়ার পর সমাজের সবার প্রতি নিজেদের দায়িত্ব পালনের জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে ছিলেন- বিশিষ্ট সাংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব ও সাবেক সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি। সমাবর্তনে বিশেষ অতিথি ছিলেন- আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, মাগুরা-১ আসনের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শেখর ও ইউজিসি সদস্য ড. বিশ্বজিৎ চন্দ্র, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বরেন্দ্র বিশ^বিদ্যালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম. সাইদুর রহমান খান। অনুষ্ঠানের শুরুতেই শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. হাফিজুর রহমান খান। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে আগত অতিথি ও গ্রাজুয়েটদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বক্তব্য রাখেন- বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম. ওসমান গণি তালুকদার।
অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘বর্তমানে সবাই পরীক্ষা দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত। কে কতটুকু শিখছে তা নিয়ে আমরা খুব বেশি ভাবিত নই। আমাদের অভিভাবক, আমাদের শিক্ষকমণ্ডলী সবাই সন্তানদের ভাল রেজাল্টের দিকে নজর দিচ্ছেন। পাঠ্যপুস্তকের পাতার মধ্যে তাদের আটকে রেখেছেন। কিন্তু জীবনটা তো অনেক বড়। জীবনটাতো শুধু পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে আটকে থাকে না।’ গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘সামনে আমরা যে পৃথিবীতে পা দিতে যাচ্ছি, সেই পৃথিবীতে কিন্তু আরও নতুন করে পরীক্ষা দিতে হবে। সেই পরীক্ষার প্রস্তুতি আমাদের কতটুকু আছে?’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন প্রচুর কর্মক্ষম মানুষ রয়েছে যা উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে নেই। এজন্য বাংলাদেশ প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রস্তুত করে উন্নত দেশগুলোতেও প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান ঘটানো যায় যা অর্থনীতির অগ্রগতি ঘটাতে পারে । এলক্ষ্যে তিনি মানসম্মত শিক্ষার উপর গুরত্বারোপ করেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের প্রশংসা করেন।’
বিশেষ অতিথি ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বরাবরই মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করে আসছে। তিনি তাঁর বক্তব্যে বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রশংসা করেন।’
মাগুড়া-১ আসনের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর বিশেষ অতিথির বক্তব্যে উচ্চমানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশে বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম. সাইদুর রহমান খানের অবদান স্মরণ করেন। তিনি বলেন, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় কখনো মানের সাথে আপস করে না।
বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান তাঁর স্বাগত বক্তব্যে বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা-নির্ভর ও গুণগতমানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার দিকে বিশেষ জোর দিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে সুদক্ষ, সুশিক্ষিত ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এই সমাবর্তনে মোট ১৫২৭ জন গ্রাজুয়েটকে ডিগ্রি প্রদান করা হয়। সমাবর্তনে দুইজনকে চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড ও ৯ জনকে ভাইস চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তরা হলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম ও ফার্মেসি বিভাগের আনিকা তাহসিন। ভাইস চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তরা হলেন-জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের আলেয়া আক্তার মৌসুমী, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের মো. সাজেদুর রহমান, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মো. নূর নবী, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিশাল কর্মকার, ইংরেজি বিভাগের ইসরাত জাহান, আইন ও মানবাধিকার বিভাগের মো. সাজ্জাক হোসেন ও ফার্মেসি বিভাগের আনিকা তাহসিন, সমাজবিজ্ঞানের আলফা আলম ও অর্থনীতি বিভাগের মো. সোহানুর রহমান।
সমাবর্তনে দেশের বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০টি বিভাগের গ্রাজুয়েটদের অভিভাবক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।
সমাবর্তনের দ্বিতীয় পর্বে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত ব্যান্ড সঙ্গীত দল ওয়ারফেজ , জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারপ্রাপ্ত জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী সামিনা চৌধুরী ও এই প্রজন্মের জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী ফাতিমা তুয যাহরা ঐশীও সঙ্গীত পরিবেশন করেন।