কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের সিন্দুক খুলতেই কাড়ি কাড়ি টাকা! আটটি সিন্দুকের সব টাকা-পয়সা ভরা হয় ১৯টি বস্তায়। দিনভর গোনা হয় এসব টাকা। গোনা শেষে এবার মিলল পাগলা মসজিদের দানবাক্সে রেকর্ড ৫ কোটি ৫৯ লাখ ৭ হাজার ৬৮৯ টাকা। টাকার সঙ্গে সোনা-রুপার অলঙ্কারসহ মিলেছে বিদেশি মুদ্রাও। এবার পাওয়া গেছে হীরের গহনাও!
প্রতি তিন মাস পর পর দানবাক্সগুলো খোলা হয়। এবার রমজানের কারণে চার মাস পর খোলা হয়েছে। এর আগে ৭ জানুয়ারি ৩ মাস ১ দিন পর দানবাক্স খোলা হয়েছিল। ২০টি বস্তায় তখন রেকর্ড ৪ কোটি ১৮ লাখ ১৬ হাজার ৭৪৪ টাকা এবং বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার পাওয়া গিয়েছিল।
শনিবার সকাল ৮টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত গণনা করে বিপুল পরিমাণের এই টাকা অলঙ্কার পাওয়া গেছে মসজিদটির দানবাক্সে।
সাধারণত ৯০ থেকে ১০০ দিনের মধ্যে দানের টাকায় ভরে যায় পাগলা মসজিদের সিন্দুকগুলো। এ কারণে প্রায় তিন মাস পর পর খোলা হয় এগুলো। এবার রমজানের জন্য চারমাস পর খোলা হয়েছে।
কিন্তু এবার সব হিসাব ছাড়িয়ে গেছে। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে খোলা হয় মসজিদের সব সিন্দুক। বিপুল টাকা-পয়সার জন্য সঙ্গত কারণেই সিন্দুক খোলার সময় নেওয়া হয় বাড়তি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। জেলা প্রশাসনের বেশ কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বড়সড় দল সারাদিন টাকা গণনা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিল।
স্থানীয়রা জানান, শুধু মুসলমান নয়, অন্য ধর্মের লোকজনও পাগলা মসজিদে বিপুল অঙ্কের টাকা-পয়সা দান করে। এই মসজিদটি সব ধর্মাবলম্বীর কাছে পবিত্রতার প্রতীক ও আস্থার জায়গা। তাদের ধারণা, এখানে দান করলে আয়-উন্নতিসহ বিপদ-আপদ দূর হবে। এ কারণে এই মসজিদের দানবাক্সে যে বিপুল পরিমাণ টাকা পাওয়া যায়, তা জেলার আর কোনো মসজিদে ওঠে না।
টাকা ও অলংকারের পাশাপাশি সিন্দুকে পাওয়া যায় বেশ কিছু চিঠি। আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সিন্দুকে পাওয়া এসব চিঠিপত্র। চিঠিতে লোকজন তাদের নানা চাওয়া লিখে রাখেন।
সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সিন্দুকের টাকা-পয়সা বস্তাবন্দি করছে দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন। পরে বস্তাগুলো ধরাধরি করে মসজিদের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। এবার সব মিলিয়ে ১৯ বস্তা টাকা পাওয়া গেছে।
সিন্দুক খোলার সময় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী তিনি জানান, টাকা গণনার কাজে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মহুয়া মমতাজ, সিনিয়র সহাকরী কমিশনার শেখ জাবের আহমেদ, সিরাজুল ইসলাম, সহকারী কমিশনার মোছা. নাবিলা ফেরদৌস, সাদিয়া আফরীন তারিন, মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি খলিলুর রহমান ও রূপালী ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) রফিকুল ইসলাম, সিবিএ নেতা মো. আনোয়ার পারভেজসহ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য এবং মসজিদ কমপ্লেক্সে অবস্থিত মাদরাসা ও এতিমখানার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছেন।
পাগলা মসজিদের টাকা জমা হয় রূপালী ব্যাংকে। এই ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী, মসজিদ কমিটির লোকজন, মাদরাসার ছাত্রসহ সব মিলিয়ে প্রায় দুই শতাধিক লোক সারা দিন টাকা গুনেছে। মসজিদের বিপুল অর্থ-সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে ২৯ সদস্যের একটি কমিটিও রয়েছে।
শনিবার দুপুর ১২টার দিকে টাকা গণনা কাজ পরিদর্শনকালে মসজিদের সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, বর্তমানে দানের টাকা জমানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ঐতিহ্যবাহী পাগলা মসজিদে আন্তর্জাতিক মানের দৃষ্টিনন্দন ইসলামিক কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দ্রুতই এর কাজ শুরু হবে। যার নামকরণ হবে ‘পাগলা মসজিদ ইসলামিক কমপ্লেক্স’। যেখানে ৬০ হাজার মুসল্লির এক সঙ্গে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা থাকবে। নারীদের জন্য পৃথক নামাজের ব্যবস্থাও থাকবে সেখানে। থাকবে সমৃদ্ধ লাইব্রেরিসহ আরও নানা আয়োজন। এ প্রকল্পের জন্য প্রাথমিকভাবে ১১৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
এর আগে পাগলা মসজিদের সাধারণ সম্পাদক ও কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মো. পারভেজ মিয়া টাকা গণনা কাজ পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি বলেন, দ্রুতই আন্তর্জাতিক মানের দৃষ্টিনন্দন ইসলামিক কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ শুরু হবে। ওই টাকার লভ্যাংশ থেকে গরিব ও অসহায় লোকদের আর্থিক সহায়তা, ক্যানসারসহ জটিল রোগে আক্রান্তদের আর্থিকভাবে অনুদান দিয়ে মসজিদটি আর্তমানবতার সেবায় ভূমিকা রাখছে।
এছাড়া করোনা মহামারীর সময় মসজিদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা রোগীদের সেবায় যন্ত্রপাতি, ওষুধপত্র কিনে দেওয়া হয়। দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের অনুদান দেওয়া হয় মসজিদের তহবিল থেকে। এসব সেবামূলক কর্মকাণ্ড সারা বছরই করে থাকে পাগলা মসজিদ।
কিশোরগঞ্জ শহরের পশ্চিমে হারুয়া এলাকায় নরসুন্দা নদীর তীরে মাত্র ১০ শতাংশ জমির উপর এই মসজিদটি গড়ে উঠেছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ মসজিদের পরিধির সঙ্গে বেড়েছে এর পরিচিতিও।