বুসান নগরীতে ২০৩০ সালের ওয়ার্ল্ড এক্সপো করতে চায় দক্ষিণ কোরিয়া। এই আয়োজনের লক্ষ্যে ২০২১ সালের জুনে ব্যুরো ইন্টারন্যাশনাল দেস এক্সপোজিশনস (বিআইই) বরাবর আবেদন করেছে দেশটি।
‘ট্রান্সফর্মিং আওয়ার ওয়ার্ল্ড, নেভিগেটিং টুয়ার্ড অ্যা বেটার ফিউচার’ (আমাদের বিশ্বকে পরিবর্তন করা, আরও ভালো ভবিষ্যৎ পানে অভিযাত্রা) এই প্রতিপাদ্য হলো দক্ষিণ কোরিয়ার প্রার্থিতার ভিত্তি। সফল হলে বুসানের নর্থ পোর্ট ডিস্ট্রিক্টে ২০৩০ সালের পহেলা মে থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এক্সপো অনুষ্ঠিত হবে।
ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০৩০ আয়োজনের জন্যে আরও চারটি দেশ আবেদন করেছে। মস্কোতে রাশিয়া, রোমে ইতালি, ওডেসায় ইউক্রেন এবং রিয়াদে সৌদি আরব একই বছর ওয়ার্ল্ড এক্সপো আয়োজন করতে চায়। আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর জন্য অনুমোদন সংস্থা (বিআইই) ২০২৩ সালের জুনে আয়োজক নগরী চূড়ান্ত করবে।
এক্সপো হলো একটি বৈশ্বিক ইভেন্ট যা মানবজাতির চ্যালেঞ্জ উত্তরণে একটি প্রতিপাদ্যে সবাইকে যুক্ত করে এবং কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০৩০
আন্তর্জাতিকভাবে নিবন্ধিত একটি প্রদর্শনী যা বিআইইর ১০০তম বার্ষিকীতে হতে যাচ্ছে। এই এক্সপোতে অতীতের ১০০ বছরের প্রতিফলন এবং ভবিষ্যতের ১০০ বছরের পরিকল্পনার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০৩০ এর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে এ কারণে যে, ওই বছরেই জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) শেষ হবে। শিক্ষা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক্সপোর প্রতিপাদ্য বিষয় আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণকারীদের ধারনা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে সমাধানের নতুন ধরনের সহযোগিতার সূচনা হতে পারে।
এটা অনেক সময় নীতিগত দলিল কিংবা মেনিফেস্টো আকারে হয়ে থাকে। এক্সপোর সাফল্যের জন্যে উন্মুক্ত, বৈচিত্র্যময়, অর্ন্তভুক্তিমূলক এবং শান্তির মূল্যবোধ প্রয়োজন।
মানবজাতি যেসব বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে; তার জন্যে নাটকীয় ও মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন। খন্ডিত ও পর্যায়ক্রমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।
বুসান ‘ট্রান্সফরমেশন’ কে বিশেষ ফোকাসে রেখে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘ট্রান্সফর্মিং আওয়ার ওয়ার্ল্ড, নেভিগেটিং টুয়ার্ডস অ্যা বেটার ফিউচার’। ট্রান্সফরমেশনকে মূল ফোকাসে রাখার মানে হলো এটা বড় ধরনের উদ্ভাবনের দিকে নির্দেশনা দিয়েছে যা প্রযুক্তিকেও ছাড়িয়ে যাবে। ট্রান্সফরমেশনে সর্বত্র সবাইকে অর্ন্তভুক্ত করতে হবে।
এই লক্ষ্য অর্জনে তিনটি সাব থিম যুক্ত করা হয়েছে। ১) পরিবেশের সঙ্গে টেকসই বসবাস, ২) মানবজাতির জন্যে প্রযুক্তি, ৩) যত্ন নেওয়া ও বিনিময়ের জন্যে প্লাটফর্ম।
এসব সাব থিম নির্ধারণ করা হয়েছে তিনটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার লক্ষ্যে— (১) জলবায়ু পরিবর্তন, (২) ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের খারাপ দিক, (৩) বিভিন্ন দেশের মধ্যে এবং নিজ দেশের অভ্যন্তরে বৈষম্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন, ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের খারাপ দিক এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে এবং নিজ দেশের অভ্যন্তরে বৈষম্যের বিষয়টি প্রাসঙ্গিক।
কারণ— (১) জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ, (২) বিশ্বে বাংলাদেশে দ্রুততম ডিজিটাল প্রযুক্তির বিস্তার ঘটছে, এবং সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বৈষম্যের প্রতি। কারণ বাংলাদেশের বিকাশ ঘটছে দ্রুততম সময়ে। প্রত্যেক সাব থিম আবার এসডিজির তিনটি মূলনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। এসডিজির এই তিনটি মূলনীতি হলো ধরিত্রী, সমৃদ্ধি এবং জনগণ।
জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের টিকে থাকার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আমরা বর্তমান উৎপাদন এবং ভোগ করার ধরন বহাল রাখতে পারব না। ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০৩০ বুসান ‘প্রকৃতির সঙ্গে টেকসই জীবন’ উন্নয়নের একটি প্লাটফর্ম হিসাবে ব্যবহার হতে পারে।
প্রযুক্তি আমাদেরকে আরামদায়ক জীবন-যাপনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এবং এটা অবশ্যই অব্যাহত থাকবে। কিন্তু এর অনেকগুলো খারাপ দিকও আছে। যেমন- ডিজিটাল বিচ্ছিন্নতা, ডিজিটাল বিভক্তি এবং মানুষের চাকরির হুমকি। আমাদেরকে অবশ্যই মানুষকেন্দ্রিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং অভিজ্ঞতার শেয়ার করতে হবে।
আমরা সবাই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। মহামারি আমাদেরকে এই শিক্ষা দিয়েছে। সবাই নিরাপদ না হলে কেউই নিরাপদ থাকবে না। একই সঙ্গে দ্রুত বিশ্বায়ন, চরম আবহাওয়া পরিবর্তন, প্রযুক্তির নতুন মাত্রা আমাদের সমাজে মেরুকরন বৃদ্ধি করেছে।
বিশ্বকে তার সব সদস্যদের অনেক ভালোভাবে যত্ন নিতে হবে। একত্রে সমৃদ্ধি অর্জন করতে চাইলে আমাদের অবশ্যই শেয়ার করতে হবে। ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০৩০ বুসান রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে এবং রাষ্ট্রের ভেতরে মানুষে মানুষে বৈষম্য দূর করার আলোচনার মাধ্যমে মানবজাতিকে সুন্দর ভবিষ্যতের পথ দেখাবে। পাশাপাশি, বৈশ্বিক সুরক্ষা জাল সৃষ্টিতেও সহায়ক হবে এই আলোচনা।
বিশ্বের বৃহৎ দশটি অর্থনীতির দেশের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া হচ্ছে বৈশ্বিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রাণকেন্দ্র। আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স, ইন্টারনেট অব থিঙ্কস, বিগ ডাটা এবং স্মার্ট মোবাইলের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়া চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়া সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও পাওয়ার হাউস। ‘কে কালচার’ নামে অধিক পরিচিত নাটক, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, এবং খাদ্যে কোরিয় সংস্কৃতি বিশ্বে ঝড় তোলেছে। বিশ্বে তারা নতুন নতুন ট্রেন্ডের জন্ম দিচ্ছে। তার অতিরিক্ত হিসাবে, দক্ষিণ কোরিয়া উন্নয়নশীল দেশ থেকে স্বল্প সময়ের মধ্যে উন্নত দেশের উন্নীত করতে পেরেছে। দক্ষিণ কোরিয়া শান্তি ও সহাবস্থান নিশ্চিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার গল্পটা পরিবর্তনের একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তারা অনেক মূল্যবান শিক্ষা অর্জন করেছে, যেখান থেকে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব অনেক কিছু শিক্ষা নিতে পারে।
ওয়ার্ল্ড এক্সপো আয়োজনের প্রার্থী বুসান হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী। এটি দেশটির সর্ববৃহৎ বন্দর নগরীও। নগরটির আছে চমৎকার অবকাঠামো। ইউরেশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরে বুসান নগর প্রবেশদ্বার। পরিবহণের জন্যে নগরীটি এক প্রাণকেন্দ্র।
দক্ষিণ কোরিয়ার অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের প্রতিনিধিত্বকারী হলো বুসান। একদিন বিশ্বের অন্যতম গরিব দেশ ছিলো কোরিয়া। ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছে।
আজ বিশ্বে একটি দাতা দেশে পরিণত হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। এই বিশাল প্রবৃদ্ধি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বুসান। কোরিয় যুদ্ধের সময়ে বুসান ছিল লাখ লাখ শরণার্থীর আশ্রয়কেন্দ্র। তাদের জন্যে স্কুলগুলো ছিলো খোলা। দ্য বুসান স্পিরিট মানে শিক্ষা, উদ্ভাবন ও সহযোগিতার মূল্যবোধ।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে বুসান সৃষ্টি করেছে ব্লকচেইন স্পেশাল জোন, বুসান ইকো ডেল্টা সিটি। স্থির করেছে গ্রীন স্মার্ট সিটির লক্ষ্য। বুসান নগরে আছে বিপুল সক্ষমতার বিমানবন্দর, উচ্চগতির রেল এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর।
গোটা বিশ্বের সঙ্গে বুসান থেকে যোগাযোগ সৃষ্টি সম্ভব। শহরটি বড় বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলন, ইভেন্ট, প্রদর্শনী আয়োজনে সক্ষম। বুসানে ২০০২ সালে এশিয়ান গেমস, ২০০৫ সালে এপেক সামিট, ২০১৪ ও ২০১৯ সালে হয়েছে কোরিয়া-আসিয়ান স্পেশাল সামিট, ২০১৫ সালে আইডিবি জেনারেল মিটিং এবং ২০২২ সালে ফিয়াটা ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস আয়োজন করেছে এই নগরী।
প্রতি বছর চার কোটি পর্যটক বুসান নগরী সফর করে থাকেন। বুসান নিয়মিত কে কালচারের বিভিন্ন উৎসব আয়োজন করে থাকে। যেমন— বুসান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেষ্টিভাল, বুসান ওয়ান এশিয়া ফেষ্টিভাল এবং জি-ষ্টার।
উপসংহারে এটা বলা যায় যে, বুসান সত্যিকার অর্থেই ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০৩০ আয়োজনে প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে যোগ্য ও উপযুক্ত।