বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে সরকারের অবস্থান নমনীয় হচ্ছে। বাধা না দিয়ে বিএনপিকে সমাবেশ করার অনুমতি দিতে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আগের রাজনৈতিক মামলায় দল দুটির নেতা-কর্মীদের গণগ্রেপ্তার না করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে এমন নির্দেশনা গেছে পুলিশ সদর দপ্তরে। সদর দপ্তর থেকে তা পাঠানো হয়েছে পুলিশের মাঠপর্যায়ে।
কয়েকটি জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ও সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। বিএনপির নেতারা বলছেন, আন্তর্জাতিক মহলের চাপে পড়ে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সরকার বিরোধী দলের প্রতি নমনীয় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির পর এটি হয়তো সরকারের ‘সমঝোতার বার্তা’র আভাস। তবে পুলিশের আচরণে সরকারের নমনীয় মনোভাব বা নির্দেশনার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তৎপর রয়েছে। তারা এই সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে চায়। তবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড়। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি দীর্ঘ দিন ধরে কর্মসূচি পালন করছে। কর্মসূচি পালন ও সমাবেশের অনুমতি পাওয়া নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেছে দলটি। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় গণসমাবেশকে ঘিরে নয়াপল্টনে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় পুলিশের।
সভা-সমাবেশে পুলিশকে উদ্দেশ করে অনেকবারই সতর্কবার্তা দেন বিএনপির নেতারা। নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা-মামলা ও নির্যাতনকারী পুলিশ সদস্যদের
বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে একটি কমিটিও গঠন করেছে বিএনপি।
নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর দৃষ্টি রেখেছে আন্তর্জাতিক মহল। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের তৎপরতাও বেড়েছে। তাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকও করছেন। এ ছাড়া গত ২৪ মে রাতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে। সূত্র বলেছে, সার্বিক এই পরিস্থিতিতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর প্রতি সরকারের মনোভাব নমনীয় হয়েছে। আগে বিএনপির কর্মসূচির দিনে আওয়ামী লীগ কর্মসূচি দিলেও তা থেকে পরে সরে এসেছে। দলটি বলছে, সংঘাত এড়াতে এই সিদ্ধান্ত। এবার বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দিতে এবং নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় না করতে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, পুলিশের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের দেওয়া নির্দেশনায় সভা-সমাবেশের জন্য বিএনপির আবেদন যাচাই-বাছাই করে বিশেষভাবে বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। সম্ভব হলে সমাবেশের জন্য চাহিদা অনুযায়ী স্থানের অনুমতি দিতে বলা হয়েছে। কোনো কর্মসূচির সময় নেতা-কর্মীদের নামে আগে থাকা রাজনৈতিক মামলায় গণহারে ধরপাকড় না করার নির্দেশনাও রয়েছে। একই নির্দেশনায় বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতের ব্যাপারেও নমনীয় থাকার পরামর্শ এবং দলটির নেতা-কর্মীদের গণগ্রেপ্তার থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে দলটিকে সভা-সমাবেশের অনুমতির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
রাজশাহী রেঞ্জের একটি জেলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সুপার গতকাল বুধবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ঈদের কয়েক দিন আগে জেলা বিএনপি একটি ছোট সমাবেশ করেছিল। ওই সমাবেশের অনুমতি, পুলিশের সহযোগিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে রেঞ্জ অফিসের বাইরেও পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা এসেছিল। সরকারের দায়িত্বশীল মহলও সমাবেশের অনুমতি দিতে বলেছিল, যা গত কয়েক বছরে হয়নি।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. মনজুর রহমান অবশ্য বলছেন, অনুমতি নিয়ে শান্তিপূর্ণ কোনো কর্মসূচি করলে পুলিশ কখনো বাধা দেয় না। পুলিশ সব সময় সহযোগিতা করে।
তবে বিএনপির নেতাদের অভিযোগ, পুলিশের আচরণে এখনো কোনো পরিবর্তন তাঁরা দেখতে পাননি। গতকাল বিএনপির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অভিযোগ করা হয়, ১৯ মে থেকে গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে করা ২১৫টি মামলায় দলের ৯ হাজার ৮০০ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮৩৬ জনকে। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘গত দেড় মাসে বিএনপির হাজারখানেক নেতা-কর্মীর গ্রেপ্তারকে কি নমনীয় আচরণ বলা যায়?’
দলীয় নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার ও তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে গত সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ঈদের ছুটিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আচরণে কোনো পরিবর্তন না পাওয়ার কথা জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান গতকাল রাতে বলেন, ‘পুলিশকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। তাদের কাছে যে রকম নির্দেশ দেওয়া হবে, তারা সেভাবেই কাজ করবে।’
এদিকে জামায়াতে ইসলামীর অভিযোগ, তাদের অনেক নেতা-কর্মীও গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন। গত ১২ বছরে ২৯৪ জন কর্মী নিহত হয়েছেন। জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখনো গণহারে ধরপাকড় করছে পুলিশ। তাদের আচরণের পরিবর্তন হয়েছে কি না, তা আগামী দিনে কর্মসূচি পালন করতে গেলে পরিষ্কার হবে।
গত ১০ জুন পুলিশের অনুমতি নিয়ে রাজধানীতে সমাবেশ করে জামায়াত। প্রায় এক দশক পর দলটির সমাবেশ করার অনুমতি পাওয়া নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা হয়। জামায়াতের সঙ্গে সরকারের আঁতাত হয়েছে বলেও সন্দেহ প্রকাশ করেন কেউ কেউ। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ে এমন সন্দেহ প্রকাশ করেন। সরকারি দলের নেতারাও এ নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘জামায়াতের প্রতি কেমন আচরণ করা হবে, এটি অনেকটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমাদের কাছে নির্দেশনা আসার পর পুলিশের অন্য সব ইউনিটকে বলা হয়েছে তাদের গণহারে গ্রেপ্তার না করে নমনীয় আচরণ করতে। তবে সভা-সমাবেশের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একটি সূত্র জানায়, জামায়াতের আগের আন্দোলনগুলোতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া নেতা-কর্মীদের একটি তালিকা করছে পুলিশ। যদি তাঁরা নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করেন, তবে সেভাবেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাহলে তাঁরা তাঁদের মতো রাজনীতি করতে পারবেন।