বিকল্প উৎস থেকে গম আমদানির উদ্যোগ


, আপডেট করা হয়েছে : 23-07-2023

বিকল্প উৎস থেকে গম আমদানির উদ্যোগ

আলোচিত ‘খাদ্য শস্য রপ্তানি’ চুক্তি থেকে রাশিয়া বেরিয়ে যাওয়ার কারণে ইউক্রেন থেকে গম আমদানি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় দেশের আটা ও ময়দার বাজার স্থিতিশীল রাখতে বিকল্প উৎস থেকে গম আমদানির উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে ভারতীয় বাজারের ওপর। এরপর কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা ও ইউরোপ থেকে গম আমদানির বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। ভারতের কাছ থেকে কোটা সুবিধায় বছরে ২৫ লাখ টন গম চাওয়া হবে। ইতোমধ্যে কোটা সুবিধায় গম আমদানির বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত একটি কমিটি কাজ শুরু করেছে। ওই কমিটির সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব যাবে ভারতে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

জানা গেছে, দেশে গমের চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় কৃষ্ণসাগর দিয়ে শস্য রপ্তানি চুক্তি থেকে রাশিয়ার সরে আসায় বিশ্ববাজারের পাশাপাশি বাংলাদেশের গমের বাজারে নতুন করে অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আমদানিকারকরা। জাতিসংঘ, তুরস্ক ও ইউক্রেনকে রাশিয়া জানিয়েছে, যে তারা চুক্তিটি আর নবায়ন করবে না। এই চুক্তিতে কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেনকে খাদ্যশস্য রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধের মধ্যেও বাংলাদেশে গম আমদানি হচ্ছিল স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু বর্তমান ঘটনাকে বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বলে মন্তব্য করেন আমদানিকারকরা। তাদের মতে, এতে আমদানি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।

বিশ্ববাজারের পাশাপাশি বাংলাদেশের গমের বাজারে নতুন করে অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, এর আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতেই বাংলাদেশে গম আমদানি কমে যায়। ওই সময়ের পর থেকে দেশে আটা  ও ময়দার দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। বর্তমান প্রতিকেজি আটা প্যাকেট ৬০-৬৫ এবং খোলা আটা ৫৮-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে দেশে এই আটা ২৮-৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। 
জানা গেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এই আশঙ্কায় গতবছরের শুরুতেই ভারতের কাছে ভোগ্যপণ্যের আমদানিতে কোটা সুবিধা চায় বাংলাদেশ। এরমধ্যে গম, চাল ও চিনি অন্যতম। কোটা সুবিধায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে বছরে ছয়টি পণ্যে ৫৮ লাখ টন অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্যপণ্য আমদানির বিষয়টি চূড়ান্ত  করা হয়। কিন্তু রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় ভারত থেকে খাদ্যশস্য বিশেষ করে গম আমদানির বিষয়টি আর নতুন করে এগোয়নি। কিন্তু এবার রাশিয়া চুক্তি থেকে সরে যাওয়ায় উদ্যোগটির বাস্তবায়ন চায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বিশেষ এই কোটা সুবিধায় পণ্য আমদানিতে ভারতকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিতে যাচ্ছে সরকার। কোটা সুবিধায় দেশটি থেকে আমদানি হবে চাল, গম, চিনি, আদা, রসুন ও পেঁয়াজের মতো পণ্য। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভারত থেকে কোটা সুবিধায় গম আমদানিতে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। বছরে ২৫ লাখ টন গম আমদানি হবে দেশটি থেকে। এছাড়া আমদানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চাল। বছরে আমদানি হবে ১৫ লাখ টন। এরপরই চাহিদা মেটাতে বছরে ১০ লাখ টন চিনি আমদানির প্রস্তাব দেওয়া হবে। ভারত থেকে কোটা সুবিধায় নিত্যপণ্য আমদানি করা যায় সেলক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও অধিদপ্তরগুলো। 
রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে গম আমদানি চালু থাকায় দেশে আটা ও গমের দাম মোটামুটি কমতে শুরু করেছিল। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারেও কমে আসছিল গমের দাম। কিন্তু রাশিয়া খাদ্যশস্য রপ্তানি থেকে সরে যাওয়ার কারণে আবার গমের বাজার অস্থির হতে পারে। গম নিয়ে সংকট বিষয়ে ইতোমধ্যে এক বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছিলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে আমদানি ব্যাহত হলে আমরা বিকল্প বাজার থেকে আমদানি করব। বিকল্প বাজার তৈরি আছে। গমের আমদানি ও সরবরাহ পরিস্থিতি সব সময় স্বাভাবিক থাকবে। এদিকে, বেশ কয়েকমাস যাবত আন্তর্জাতিকবাজারে দাম কমে যাওয়ায় সরকারিভাবে এ বছর বিপুল পরিমাণ গম আমদানি হয়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি প্রায় প্রতিটি বৈঠকেই গম, চাল, চিনি ও ভোজ্যতেলের আমদানি অনুমোদন দিয়েছেন। মূলত দেশে খাদ্যশস্যের মজুত বাড়াতে সরকারিভাবে আমদানি বাড়ানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, খাদ্যশস্যের দাম নিয়ন্ত্রণ এবং সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্যই সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে। সামনে আরও আমদানি হবে।  
তথ্যমতে, সরকারিভাবে আমদানি পর্যাপ্ত পরিমাণে হলেও বেসরকারিখাতে আমদানি সেইভাবে বাড়েনি। যদিও গম ও আটার বাজার নিয়ন্ত্রণে বেসরকারিখাতের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। দেশে প্রতিবছর ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন গমের চাহিদা তৈরি হয়েছে। এর ৮৫ শতাংশ আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। বেসরকারিখাতের উদ্যোক্তারাই আবার ৮০ ভাগ গম আমদানি করে থাকেন। এ কারণে রাশিয়া খাদ্যশস্য চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে চাপে পড়বে বেসরকারিখাত। এতে করে দেশে গম, আটা ও ময়দার দাম বেড়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় দ্রুত গমের বিকল্প বাজার তৈরি হওয়া উচিত বলে মনে করা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, পুরো বিষয়টি সরকারের নজরে রয়েছে। শীঘ্রই এ বিষয়ে আমদানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। এছাড়া ভারত থেকে কোটা সুবিধায় যাতে গম আমদানি করা যায় সেই বিষয়ে জোর দেওয়া হবে। এর পাশাপাশি কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা এবং ইউরোপের কোন কোন দেশ থেকেও গম আমদানি করা হতে পারে। এ বিষয়েও খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। 
এদিকে, চুক্তি স্থগিতের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম টনপ্রতি ১৫ থেকে ২০ ডলার বেড়েছে বলে জানিয়েছেন দেশে গমের অন্যতম বৃহৎ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নাবিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম। তার মতে, বর্তমানে দেশের ব্যবসায়ীদের কাছে যে পরিমাণ গম মজুত আছে তাতে আগামী অক্টোবর পর্যন্ত এর দাম বাড়বে না। এদিকে, বন্দরনগরী চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ পাইকারি বাজারে গমের দাম বাড়তে শুরু করেছে। প্রতি মণ গম ১ হাজার ৭৫০ থেকে ১ হাজার ৮২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

দেশের অন্যতম বৃহৎ আমদানিকারক মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহকারী মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার বলেন, শস্য চুক্তি নবায়ন না হওয়ার মতো বৈশ্বিক ঘটনা দেশের বাজারে প্রভাব ফেলতে পারে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে গমের আমদানি ৩ দশমিক ৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছিল ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার টনে। আগেরবছর তা ছিল ৪০ লাখ ১২ হাজার টন। গত অর্থবছরে শস্য আমদানি ৮ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œœ ছিল। শস্য আমদানির জন্য বাংলাদেশ বিশ্ববাজারের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
জানা গেছে, চলমান বৈশ্বিক সংকট সামনে রেখে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো থেকে ভোগ্যপণ্য আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ভারতকে। কারণ ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হয়। সরকারি সংস্থাগুলো বলছে, এ মুহূূর্তে দেশে দ্রুত এবং স্বল্প খরচে পণ্য আমদানিতে ভারতের বিকল্প কোনো বাজার ব্যবসায়ীদের সামনে নেই। এজন্য ভারত থেকেই ভোগ্যপণ্য আমদানি সহজ ও নিরাপদ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বছরভিত্তিক মোট চাহিদা, দেশজ উৎপাদন, মোট আমদানির পরিমাণ এবং আমদানির প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে ভারতের নিকট বছরভিত্তিক সুনির্দিষ্ট সরবরাহের প্রস্তাব চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছে।

এতে প্রতিবছর সরকারি পর্যায়ে ৮-১০ লাখ টন চাল এবং বেসরকারি পর্যায়ে ৫-৭ লাখ টন মোট ১৫ লাখ টন চাল আমদানি করা হবে। বছরে সরকারি পর্যায়ে ৫-৭ লাখ টন গম এবং বেসরকারি পর্যায়ে ২০ লাখ মোট ২৫ লাখ টন গম আমদানি করা হবে। এছাড়া চিনি, পেঁয়াজ, রসুন এবং আদা শুধু বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা আমদানি করবেন। এতে বছরে ১০ টন চিনি, ৬ লাখ টন পেঁয়াজ, ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টন রসুন এবং ১ লাখ টন আদা আমদানি করা হবে।


  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার