রেলে বাড়ছে না আয় কমছে গতি


, আপডেট করা হয়েছে : 04-08-2023

রেলে বাড়ছে না আয় কমছে গতি

রেলের বরাদ্দে কমতি নেই। গত ১৪ বছরে রেল উন্নয়নে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা ব্যয় করেছে বর্তমান সরকার। প্রতিবছরই বরাদ্দ বাড়ছে। কিন্তু গতি বাড়ছে না ট্রেনের। লোকসান না কমে বরং লাফিয়ে বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরেই প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। মেগা প্রকল্প দুটিও লোকসান বাড়াবে। কিছু প্রকল্পে বরাদ্দের অর্থ প্রায় পুরোটাই জলে গেছে। এর অন্যতম ‘ডেমু ট্রেন ও দ্রুতগতির লাইন নির্মাণ প্রকল্প।’ আবার এমন কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে যার সুফল পাচ্ছেন না যাত্রীরা। এছাড়া অধিকাংশ প্রকল্পের ব্যয় দুই থেকে তিনগুণ বেড়েছে। অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প গ্রহণ এবং অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।


রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, রেলে এমনও প্রকল্প আছে-যা এক থেকে দেড় যুগ ধরে চলছে। অথচ ওইসব প্রকল্পের মেয়াদ ছিল সর্বোচ্চ ৪ বছর। রেলওয়েতে বিশেষ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত দুটি মেগা প্রকল্প আছে। এর একটি হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এবং অপরটি ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে যশোর পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন। দুটিতেই বেশ কয়েকবার সময় ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। সেপ্টম্বরের মধ্যেই বিশেষ প্রকল্প দুটি উদ্বোধন হবে। রেল বলছে, প্রকল্প দুটিতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা। এ দুটি কাজ শেষ করার মাধ্যমে সরকার চমক সৃষ্টি করেছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, এ দুই প্রকল্প রেলের লোকসান আরও বাড়াবে। কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, রেল সেবা খাত, লাভ-লোকসান দেখে ট্রেন চলে না। স্বাধীনতার পর রেল লাভের মুখ কখনও দেখেনি।


রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন যুগান্তরকে বলেন, রেলে বর্তমান সরকার ব্যাপক উন্নয়ন করছে। তবে লোকসান এখনো কমছে না। তিনি বলেন, চলমান প্রকল্পগুলোর কাজ হলে পুরো রেলে আমূল পরিবর্তন আসবে। তখন নিশ্চয় লোকসান কমে রেল লাভের মুখ দেখবে। রেল হচ্ছে সেবা খাত, আমরা সেবার দিকেই বেশি নজর দেই। রেলে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। কাউকেই ক্ষমা করা হচ্ছে না। উন্নয়নের সুফল নিশ্চয় সাধারণ যাত্রীরা ভোগ করছেন। তিনি বলেন, একমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারই রেলের উন্নয়নে কাজ করছে। অন্য সরকারগুলো রেলকে ধ্বংস করেছে।


বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহণ বিশেষজ্ঞ ড. এম সামছুল হক যুগান্তরকে বলেন, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ট্রেন পরিচালনায় লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশে এর পুরোটাই উলটো। বর্তমান সরকার রেলে ব্যাপক উন্নয়ন করছে। ২০১০ সাল থেকে বিপুল বিনিয়োগ শুরু করে। কিন্তু, অপরিকল্পিত প্রকল্প এবং দুর্নীতির কারণে রেলে সেবা যেমন বাড়েনি-বাড়েনি আয়ও। প্রতি বছরই লোকসান বাড়ছে। নিশ্চয় ভুল পরিকল্পনা কিংবা যথাযথ স্থানে টাকা খরচ করা হচ্ছে না। জরাজীর্ণ রেলপথ যুগের পর যুগ ধরে শুনে আসছি। তাহলে বরাদ্দের টাকা যায় কোথায়। লাইন, সেতু দুর্বল কেন। এসব খাতে যেসব কর্মকর্তা রয়েছেন, তাদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনা জরুরি।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেগাসহ ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে রেলের লোকসান বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নয়ন প্রকল্পে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা না থাকা, ট্রেনের সংখ্যা না বাড়ানো, রেলের পতিত জমি যথাযথ ভাবে ব্যবহার না করা এবং উন্নয়ন কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করতে না পারা-লোকসানের অন্যতম কারণ। এছাড়া প্রতিদিন চলা ৩৭৪টি যাত্রীবাহী ও ৫০টি মালবাহী ট্রেন কোচস্বল্পতা নিয়ে চলছে। সক্ষমতা অনুযায়ী কোচ নিয়ে ট্রেনগুলো চলতে পারলে বর্তমান সময়ের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি আয় করতে পারত। কিন্তু কোচস্বল্পতার কারণে প্রতিবছর ট্রেন পরিচালনায় ৭০০ কোটি টাকা আয় হয়। বর্তমানে একেকটি আন্তঃনগর ট্রেন চলছে ৮ থেকে ১৬টি কোচ নিয়ে। অথচ ইঞ্জিনের সক্ষমতা অনুযায়ী একটি আন্তঃনগর ট্রেন ২৫ থেকে ২৮টি কোচ নিয়ে চলতে পারে। রেলের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, অনেক প্রকল্প আছে, ইঞ্জিন-কোচ সময়মতো না কিনে নতুন নতুন রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে। নতুন মিটারগেজ লাইন নির্মাণের ৮-১০ বছরের মধ্যেই তা ভেঙে আবারও নতুন করে লাইন স্থাপনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ইঞ্জিন-কোচের সংকট জেনেও মন্ত্রী, সংসদ-সদস্যদের অনুরোধে নতুন নতুন আন্তঃনগর ট্রেন চালু করা হয়েছে বিভিন্ন রুটে। অবকাঠামো ও ইঞ্জিন-কোচ কেনার প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতি তো আছেই। ফলে ট্রেনের গতি না বেড়ে কমছে। বাড়ছে লোকসান।


জানা যায়, গত ১৪ বছরে শুধু রেলপথ, সেতু, ভবন নির্মাণ এবং ইঞ্জিন-কোচ ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর প্রায় ৭৫ শতাংশ অর্থ বিদেশ থেকে ঋণ হিসাবে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রতিদিনের পরিচালন ব্যয়, বেতন-ভাতাসহ রাজস্ব খাতে এ সময় আরও প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। রেলওয়ের হিসাব বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সংস্থাটি লোকসান দিয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে সংস্থাটি লোকসান প্রায় ১৭০০ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ সালে লোকসান ছিল ১৭৫১ কোটি টাকা।


বর্তমান সরকার ২০০৯ সালের পর ১৫২টি নতুন ট্রেন চালু করেছে। ৫০৩ কিলোমিটার নতুন রেলপথ, ১০৪টি নতুন রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করেছে। বিদ্যমান ৪৪টি ট্রেনের রুট বর্ধিত করা হয়েছে। এছাড়া ৮৪টি লোকোমোটিভসহ প্রায় ১২শ নতুন কোচ ও ওয়াগন সংগ্রহ করেছে। রেলপথ মেরামতের জন্য প্রতিবছরই বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। রেলের প্রকৌশল দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের রেলপথ পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এ রেলপথ দিয়ে গড়ে ৬৪ কিলোমিটারের বেশি গতি উঠে না। অথচ সরকার ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন ইঞ্জিন ও কোচ সংগ্রহ করেছে। বেশি দামে ক্রয় করা ইঞ্জিন-কোচের সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ যাত্রীরা।


চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার এবং ঢাকার কমলাপুর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার রেলপথে সেপ্টেম্বরে যাত্রীবাহী ট্রেন চলবে। ইতোমধ্যে প্রস্তুতিও প্রায় শেষ। ঢাকা থেকে যশোর পযর্ন্ত পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. আফজাল হোসেন যুগান্তরকে জানান, ২৫ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই কমলাপুর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙা পর্যন্ত চলাচলকারী যাত্রীবাহী ট্রেন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, শুরুতে এ পথে দুটি ট্রেন চলবে। এ পথের যাত্রীদের পদ্মা সেতুর কারণে অতিরিক্ত ভাড়া গুণতে হবে। প্রকল্পের মান ও ব্যয় অনুযায়ী এ পথে ন্যূনতম ২০ জোড়া (৪০টি) ট্রেন চালাতে পারলে কিছুটা হলেও ব্যয় কমবে। অন্যথায় নতুন এ প্রকল্পে যে হারে ব্যয় বাড়বে তাতে লোকসানের পাল্লা আরও ভারী হবে।


চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের প্রকল্প পরিচালক মো. মফিজুর রহমান যুগান্তরকে জানান, নতুন এ পথে জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতু দ্রুত মেরামতের কাজ চলছে। এ সেতু হয়েই ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করবে। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এ প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধন করার কথা আছে। নতুন এ পথে কী পরিমাণ ট্রেন চলাচল করলে লোকসান কমবে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা বলা কঠিন। রেল সেবা খাত, লাভ করা সহজ নয়। এদিকে রেলের এক প্রকৌশলী বলেন, কালুরঘাট মেরামত করা হচ্ছে ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে। এর আগেও রেল ২ বার এ সেতু মেরামত করেছিল। রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী বলেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও ঢাকা-ভাঙ্গা নতুন রেলপথে যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনায় প্রস্তুতি শেষের পথে। ট্রেনের নাম কিংবা ভাড়া এখনো নির্ধারণ হয়নি। রেলের আয় বাড়াতে হলে ব্যয় কমাতে হবে। অপারেশন খাতে সবচেয়ে কম ব্যয় হয়। আমরা শুধু আয় করি। অন্য দপ্তর ব্যয় করে। তবে নতুন দুই রুটে পর্যাপ্ত ট্রেন পরিচালনা করা গেলে আয় না বাড়লেও, ব্যয় কমবে। শুরুতে আমরা তিনটি ট্রেন পরিচালনা করব।



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার