সচিবালয়ের বাইরে একটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্বে থাকা এক অতিরিক্ত সচিব সম্প্রতি ব্যক্তিগত কারণে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে ভিসার জন্য আবেদন করেছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী তাঁর সাক্ষাৎকার নেয় মার্কিন দূতাবাস। সাক্ষাৎকার চলে টানা ৪০ মিনিটের বেশি। সরকারি-বেসরকারি, সামাজিক-রাজনৈতিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক অনেক প্রশ্ন করা হয়। সেই অতিরিক্ত সচিব পরে এক ঘরোয়া আলোচনায় বলেন, জীবনে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে তিনি পড়েননি। আগেও অনেকবার ভিসা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন; কিন্তু ভিসা পেতে এমন জেরার মুখে পড়তে হয়নি কখনো। নিজের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিবের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি এমন কথা বলেন। ওই ঘরোয়া আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন—এমন এক কর্মকর্তার কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা জানান, অতিরিক্ত সচিবের বিবরণ শোনার পর সেখানে উপস্থিত দুই যুগ্ম সচিব বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে এভাবে প্রতিপক্ষ বানানো উচিত হয়নি সরকারের। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন এবার সম্ভব নয়। হামলা-মামলা দিয়ে বিরোধীদের হটানো গেলেও ক্ষমতাধর বিদেশিদের সামলানো সহজ হবে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা এক যুগ্ম সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখন প্রশাসনে প্রধান ইস্যু নির্বাচন। প্রভাবশালী অনেক কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ ইউরোপীয় দেশগুলোতে পাড়ি জমাতে ব্যস্ত। চাকরি শেষে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বিদেশে অবসর কাটানোই তাঁদের স্বপ্ন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি তাঁদের সেই স্বপ্নের পথে বাধা হতে যাচ্ছে। এ কারণে প্রশাসনে এখন চলছে এলাকা, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাচভিত্তিক আড্ডা। আলোচনার মুখ্য বিষয়, কীভাবে হবে এবারের নির্বাচন। আগের মতোই নাকি অবাধ-নিরপেক্ষ হবে! কারাই বা আগামী দিনে দেশ শাসন করবে।
প্রশাসনের একাধিক সূত্রের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার পর প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা আতঙ্কে আছেন। বিদেশিদের চাপে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করাকেও অনেক কর্মকর্তা বাঁকা চোখে দেখছেন। ঈদুল আজহার পর ময়মনসিংহ, বরিশাল, রাজশাহী ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারসহ তিন দফায় দেশের অন্তত ৩০ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদেও বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এক মাস আগে কয়েকজন সাবেক ডিসিকে (বর্তমানে যুগ্ম সচিব) কয়েকটি বিভাগে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার পদে বদলি করা হলেও অনেকেই নতুন কর্মস্থলে যোগ দেননি। বিগত সময়ে সুনাম ও দাপটের সঙ্গে তাঁরা মাঠে কাজ করে এলেও নির্বাচনকালে মাঠে যেতে অনীহা দেখাচ্ছেন। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচিতে জনসমাগমও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন কেউ কেউ। বিষয়টি নজর এড়ায়নি সরকারের শীর্ষ মহলেরও।
এমন পরিস্থিতিতে গত ৩১ জুলাই রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘বঙ্গবন্ধু জনপ্রশাসন পদক-২০২৩’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন দেখে কর্মকর্তাদের ভয় না পাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘একটু আন্দোলন-সংগ্রাম দেখে ভয় পাবেন না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাবেক সচিব বলেন, ‘প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মনে ভয় আছে বলেই প্রধানমন্ত্রী এমন কথা বলেছেন, এটাই আমার বিশ্বাস। বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনে ভয় না পাওয়ার কথা বলা ঠিক হয়নি। কারণ, এটা কোনো দলীয় অনুষ্ঠান ছিল না। তিনি সংবিধান সমুন্নত রেখে নিরপেক্ষভাবে নির্ভয়ে কাজ করতে বলতে পারতেন।’
একাধিক কর্মকর্তা জানান, ডিসি-ইউএনও পদ ছাড়া মাঠপ্রশাসনে এখন কেউ যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। অনেকে ওই ধরনের বদলি ঠেকাতে তদবির করছেন। কেউ কেউ সফলও হয়েছেন।
ওই কর্মকর্তারা আরও জানান, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের ছয় মাস আগেই প্রশাসনসহ নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের নির্বাচনী পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছিল। এবার নির্বাচনের চার মাস বাকি থাকলেও এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা পাওয়া যাচ্ছে না। গত ২৪ জুলাই সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ডেকে ‘অনানুষ্ঠানিক সচিব সভা’ করা হলেও সেখানে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা হয়নি। শুধু ক্ষমতাসীনদের তিন মেয়াদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে প্রচার করতে বলা হয়েছে। সরকার এখন জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিকে সামলাতেই ব্যস্ত। তাদের চাপের কারণে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হচ্ছে।
সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনে বসেন—এমন এক অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘গত দুই মেয়াদে নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছি। নির্বাচনের ছয়-সাত মাস আগেই ফাইনাল কর্মপরিকল্পনা পাওয়া যেত। এবার এখনো এ ধরনের কিছু নেই। মাঠে থাকা গুরুত্বপূর্ণ অনেক কর্মকর্তা অভিজ্ঞতার জন্য ফোন করে এ বিষয়ে জানতে চান।’
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির কারণে প্রশাসনের একশ্রেণির কর্মকর্তার মধ্যে ভয় ও উদ্বেগ কাজ করছে। গত কয়েক বছরে যেসব কর্মকর্তা দলীয় ক্যাডারের মতো কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে এই ভয় ও উদ্বেগ বেশি। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কর্মকর্তাদের ভয়-উদ্বেগ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।’