দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যালট পেপারে অনুষ্ঠিত হলেও নির্বাচনী কার্যক্রমে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করার প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এ ক্ষেত্রে পেশিশক্তির নিয়ন্ত্রণ ও প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলে বাধাদান ঠেকাতে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে ই-ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনলাইনে জামানতের টাকা পরিশোধের সুযোগও থাকবে। অন্যদিকে ভোট কেন্দ্রের নাম ও ভোটার নম্বর খুঁজে পাওয়ার ভোগান্তি কমাতে ‘বাংলাদেশ ইলেকশন অ্যাপ’ নামে একটি অ্যাপ তৈরি করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এই অ্যাপে ভোটারের তথ্যের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের জন্য রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, ডিসি, এসপি, ওসিসহ নির্বাচনের দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের পরিচয়, ফোন নম্বর দেওয়া থাকবে। ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন এই অ্যাপ তৈরি করতে ৫ কোটি টাকার বেশি খরচ হতে পারে। ভোটার, রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, রিটার্নিং অফিসার, ইসি ও সচিবসহ অন্যরাও এ অ্যাপে প্রবেশ করতে পারবেন।
চলতি বছর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করার পরিকল্পনা ধরে কাজ এগিয়ে নিচ্ছে কমিশন। এ ক্ষেত্রে নভেম্বরের শুরু বা মাঝামাঝিতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। ব্যালট পেপারে ৩০০ আসনে ভোট করতে রোডম্যাপ অনুযায়ী প্রস্তুতিমূলক কাজ চলছে। নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন কার্যক্রম এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। চলছে নির্বাচন পর্যবেক্ষক তালিকা চূড়ান্ত করার কাজ। নির্বাচন সামনে রেখে সারা দেশে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ঢেলে সাজানো হচ্ছে। ৩০ জুলাই ভোট কেন্দ্র ও ভোটকক্ষ নির্ধারণে সারা দেশে কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছে ইসি। ইসির কর্মকর্তা এবং ভোট কেন্দ্র নির্ধারণ কমিটির সদস্যরা সম্ভাব্য কেন্দ্র পরিদর্শন করছেন।
প্রযুক্তিনির্ভর সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যালট পেপারে হলেও প্রার্থীদের সুবিধা এবং ভোটারদের ভোগান্তি কমাতে নির্বাচন কমিশন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিনির্ভর নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব ধরনের প্রস্তুতি চলমান। তিনি বলেন, এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে, যা ইতোমধ্যে কয়েকটা নির্বাচনে পাইলটিং হিসেবে পরীক্ষা করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন ‘বাংলাদেশ ইলেকশন অ্যাপ’ নামে একটি অ্যাপ তৈরি করছে। এ অ্যাপ দিয়ে ভোটাররা সহজে প্রার্থীর নাম, পরিচিতি, ছবি, দলীয় পরিচয়, প্রতীক ও প্রার্থীর হলফনামার তথ্য দেখতে পারবেন। উপরন্তু ভোট কেন্দ্র এবং ভোটার নম্বর, ভোট কেন্দ্রের ছবিও দেখতে পাবেন। ভোট শেষে আসন/কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল, দলভিত্তিক প্রাপ্ত আসন সংখ্যা এবং নিকটতম প্রার্থীর পরিচিতি ও প্রাপ্ত ভোটসংখ্যাও দেখতে পারবেন যে কেউ। তিনি বলেন, ‘আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। এখন স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে সবকিছুর আবেদনই অনলাইনে সাবমিশন হচ্ছে। অনলাইনে সাবমিশন স্বচ্ছতা ও সঠিকতার বহিঃপ্রকাশ।’ তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধিরা মোটরবহর ও মিছিল নিয়ে স্লোগান দিয়ে শোডাউন এবং পেশিশক্তি প্রদর্শন করে মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় প্রথম দিন নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন। অভিযোগ আছে, যারা মনোনয়ন জমা দিতে যান তাদের কেউ কেউ বাধাগ্রস্তও হন। আবার জমা দেওয়ার পর প্রত্যাহারের জন্য বল প্রয়োগ করা হয়। ফলে কোথাও কোথাও শেষ পর্যন্ত একক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বিদ্যমান থাকে।
অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিল পদ্ধতি : নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী প্রার্থী যে কোনো স্থান থেকেই অনলাইনে সম্পূর্ণ মনোনয়নপত্র দাখিল করতে পারবেন। প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিলের জন্য অনলাইনেই জামানতের টাকা পরিশোধ করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীকে ইসির ওয়েবসাইটে ‘অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিল’ লিংকে প্রবেশ করে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, নাম, জন্মতারিখ, মোবাইল নম্বর ও ই-মেইল নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন শেষ হলে যে মোবাইল নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে, সেই নম্বরে ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড চলে যাবে। পরে লগইন পেইজে ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করতে হবে। প্রার্থীর ড্যাশবোর্ডের বাঁ পাশের মেনু থেকে পর্যায়ক্রমে প্রার্থী মনোনয়ন, ব্যক্তিগত তথ্য, হলফনামা এবং বিভিন্ন কাগজপত্র সংযুক্ত করতে হবে। সঠিকভাবে মনোনয়নপত্র দাখিল হলে মোবাইলে বার্তার মাধ্যমে নিশ্চিত করবে নির্বাচন কমিশন। তবে অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের ক্ষেত্রে প্রার্থী, প্রস্তাবক ও সমর্থনকারীর চেহারা শনাক্ত করা হবে ফেস রিকগনিশন সিস্টেমের (এফআরও) মাধ্যমে।
অ্যাপে যা থাকবে : নির্বাচনী এলাকার নাম ও নম্বর; প্রার্থীর নাম, পরিচিতি, ছবি, দলীয় পরিচয়, প্রতীক ও প্রার্থীর হলফনামার তথ্য; ভোট কেন্দ্রের তথ্য (কেন্দ্রের নাম, কেন্দ্রের ছবি, গুগল ম্যাপে প্রদর্শন); কেন্দ্র ও ভোটারের তথ্য (ভোটাররা যাতে দেখতে পান কোন কেন্দ্রে ভোট দিতে হবে); ভোট ও আসনভিত্তিক মোট ভোটারসংখ্যা; নির্বাচন শেষে আসন/কেন্দ্রভিত্তিক কোন প্রার্থী কম ভোট পেয়েছেন তা সংখ্যায় ও চার্টের মাধ্যমে দেখানো হবে; দলভিত্তিক প্রাপ্ত আসন সংখ্যা এবং নিকটতম প্রার্থীর পরিচিতি ও প্রাপ্ত ভোট সংখ্যাও দেখা যাবে অ্যাপে। এ অ্যাপে ভোটার, রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, রিটার্নিং অফিসার, সচিব, কমিশনসহ সবার প্রবেশাধিকার থাকবে। সাংবিধানিকভাবে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। সে ক্ষেত্রে ১ নভেম্বর শুরু হবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষণ গণনা। নির্বাচন কর্মকর্তারা বলছেন, প্রথা অনুযায়ী ভোটের তারিখের আগে ৪০-৪৫ দিন সময় রেখে তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এ ক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র জমা, বাছাই, প্রত্যাহারের সময় ও প্রতীক বরাদ্দের পর প্রচারের জন্য সময় রাখা হয়। প্রচারণার জন্য সর্বোচ্চ তিন সপ্তাহ, মনোনয়নপত্র জমায় ১০-১৫ দিন, বাছাই ৪ দিন, আপিল নিষ্পত্তি ৪-৭ দিন, প্রত্যাহারের ৭ দিন সময়ও দেওয়া হয়। নির্বাচন কমিশন বৈঠক করে সার্বিক বিষয় পর্যালোচনার পর তফসিল চূড়ান্ত করে। গত ১১টি সংসদ তফসিল ঘোষণার পর মনোনয়নপত্র জমা থেকে ভোটের তারিখ পর্যন্ত সর্বনিম্ন ৪২ দিন এবং সর্বোচ্চ ৭৮ দিন সময় রেখে তফসিল ঘোষণার নজির রয়েছে। সব শেষ নবম, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয় ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর, ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর ও ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর। এবার ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট করতে গেলে নভেম্বরের শুরু থেকে দ্বিতীয়ার্ধের মধ্যেই ভোটের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। নির্বাচনের ক্ষণ গণনা শুরুর পরপরই ভোটের যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করার পাশাপাশি আন্তমন্ত্রণালয় সভা ও সব শেষ প্রস্তুতি অবগত করে প্রথা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি রয়েছে। এরপর কমিশন বসে ভোটের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে। ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন ভোটারদের নিয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় ভোটার দাঁড়াবে প্রায় ১১ কোটি ৯১ লাখের বেশি। এত ভোটারের নির্বাচনে প্রায় ৪৫ হাজার ভোট কেন্দ্র, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা মিলিয়ে ১০-১২ লাখের মতো লোক বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন। ব্যালট পেপার, ব্যালট বক্স, নির্বাচনী সামগ্রী, প্রশিক্ষণ, পরিবহন, জ্বালানিসহ নির্বাচন পরিচালনায় অন্তত ৬০-৭০টি খাতে টাকা ব্যয় হবে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের খরচ ও পারিশ্রমিক বেড়ে যাওয়ায় প্রতিবারই সে অনুযায়ী নির্বাচনী ব্যয় বাড়ছে। ভোট গ্রহণে যতজন নির্বাচনী কর্মকর্তা লাগে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও লাগে বেশ। পুরো নির্বাচন পরিচালনার ব্যয়ের একটি বড় অংশ চলে যায় আইনশৃঙ্খলা খাতে। ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি অর্থবছর ইসির বরাদ্দ ২ হাজার ৪০৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। বরাদ্দের মধ্যে পরিচালন খাতে ২ হাজার ১২৪ কোটি ৪ লাখ টাকা এবং উন্নয়ন খাতে ২৮২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা রাখা হয়েছে।