রাজধানীর উত্তরার আবদুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে হাতের ডানে বেড়িবাঁধ রোড। সেই রোড ধরে সামনে এগোলেই ফায়েদাবাদ চুয়ারিটেক এলাকা। সেই এলাকার ১৯৫ নম্বর বাড়িতে একটি একান্নবর্তী পরিবারের বাস।
এই পরিবারের সদস্য সংখ্যা ২৭ জন। দুই মাসে তাদের মধ্যে ১৭ জনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ছিলেন পরিবারের বৃদ্ধ মা ও আট শিশু-কিশোরও।
আক্রান্ত হয়েছেন পরিবারের ভাই ও তাদের স্ত্রীরা। বেঁচে থাকতে গত দুই মাসে ডেঙ্গুর সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে এই পরিবারকে। চিকিৎসায় ব্যয় হয়েছে ৮ লাখ টাকা।
এই পরিবারের ডেঙ্গুর সঙ্গে যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। সবাই সেরে উঠলেও ডেঙ্গু-পরবর্তী জটিলতা এখনো রয়ে গেছে আক্রান্তদের কারও কারও মধ্যে। আক্রান্ত সদস্যদের পুরোপুরি সুস্থ করে তুলতে এখন চলছে ডেঙ্গু-পরবর্তী যুদ্ধ।
পরিস্থিতি বর্ণনা করে এই পরিবারের সেজো ছেলে সারোয়ার হোসেন খান নাহিদ বলেন, শেষ দুই মাস আমাদের পরিবার রীতিমতো ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। মা অসুস্থ।
তার বাচ্চা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সেই বাচ্চাও অসুস্থ। মাকে কে সেবা করবে, বাচ্চাকে কে সেবা করবে। এমন একটা দুর্বিষহ সময় গেছে আমাদের।
বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং উত্তরা ক্লাব ও ধানমন্ডি শেখ জামাল ক্লাবের সাবেক সেক্রেটারি সারোয়ার হোসেন নাহিদ নিজেও আক্রান্ত হয়েছিলেন ডেঙ্গুতে।
সে সময়কার পরিস্থিতি সামলানোর প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, একান্নবর্তী পরিবার হওয়ার কারণে সবাই মিলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পেরেছি। কিন্তু খুব দুর্ভোগ গেছে আমাদের ওপর দিয়ে।
মা যখন আক্রান্ত হলেন, তখন ভাইয়েরা গিয়ে সেবা করেছি। এক ভাই অসুস্থ হলে আরেক ভাই সেবা করেছে। ছোট ভাইয়ের বউ অসুস্থ হলো। তখন বোন গিয়ে সেবা করেছে। এভাবে সবাই মিলে-মিশে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি।
দুই মাসে আক্রান্ত ১৭ জন : গত জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই পরিবারে প্রথম ডেঙ্গু দেখা দেয়। প্রথম আক্রান্ত হন পরিবারের বড় মেয়ে ৫১ বছর বয়সী নাজমুন নাহার শিল্পী। এর দুদিন পর আক্রান্ত হন ৭২ বছর বয়সী পরিবারের বৃদ্ধ মা।
এরপর একে একে আক্রান্ত হন পরিবারের সেজো ছেলে, তার স্ত্রী ও বাচ্চা, ছোট ছেলের স্ত্রী ও বাচ্চা, বড় মেয়ে ও বড় ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা মিলে ১৭ জন। সর্বশেষ আক্রান্ত হয়েছিল পরিবারের ছোট ছেলের ছোট বাচ্চা ইরতেশাম। গত ১০ দিন আগে শিশুটি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে।
আক্রান্তদের ১৭ জনের মধ্যে আটজনই ছিল শিশু। এর মধ্যে ছোট ছেলের তিন বাচ্চা, সেজো ছেলের এক বাচ্চা, আরেক ছেলের এক মেয়ে ও বড় ছেলের তিন সন্তান রয়েছে। এসব শিশুর বয়স সর্বনিম্ন সাড়ে চার বছর থেকে সর্বোচ্চ ২০ বছর।
এই দীর্ঘ দুই মাস ডেঙ্গুর সঙ্গে যুদ্ধে রাতের পর রাত নির্ঘুম কেটেছে পরিবারের অন্য সদস্যদের। আক্রান্তদের কারও কারও জটিলতা রীতিমতো ভয় পাইয়ে দিয়েছিল অন্যদের।
সেই পরিস্থিতি তুলে ধরে সেজো ছেলে বললেন, সবচেয়ে জটিল অবস্থা ছিল আমার স্ত্রী, মা, বড় বোন ও ছোট ভাইয়ের ছেলের। তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসক বলেছিল, প্লাটিলেট লাগবে। আম্মার প্লাটিলেট নেমে এসেছিল ২৯ হাজারে।
চিকিৎসকদের পরামর্শে তার জন্য রক্ত তৈরি করে রেখেছিলাম। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমত পরদিনই আম্মার প্লাটিলেট বেড়ে যায়। তখন আর প্লাটিলেট লাগেনি। আমাদের একজনেরও প্লাটিলেট লাগেনি।
চিকিৎসায় ব্যয় আট লাখ টাকা : ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যয় সংকুলান করতে গিয়েও হিমশিম খেতে হয়েছে এই পরিবারকে। সবমিলে ১৭ জনের চিকিৎসায় ব্যয় হয়েছে আট লাখ টাকার বেশি।
এ ব্যাপারে সারোয়ার হোসেন খান নাহিদ বলেন, এই দুই মাস চিকিৎসা ব্যয় পরিবারের সবাই মিলেই দিয়েছি। শুধু হাসপাতালের বিলই দিতে হয়েছে সাত লাখ টাকার মতো।
এর বাইরে ওষুধ, রোগীর পথ্য ও রোগীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যারা থেকেছেন, তাদের খাওয়া-দাওয়ায় একটা মোটা অঙ্কের টাকা গেছে। একটা ডাবের দাম ২০০ টাকা।
একজন রোগী যদি ছয় দিন হাসপাতালে থাকে ও প্রতিদিন তাকে ছয়টা করে ডাব খাওয়ানো লাগে, তাতে খরচ পড়ে দৈনিক ১২০০ টাকা।
সে হিসেবে ছয় দিন একজন রোগীর পেছনে শুধু ডাব কিনতেই গেছে সাত-আট হাজার টাকা। এর বাইরে আনার, মাল্টা, অন্যান্য খাবারও ছিল। সবমিলে ১৭ জনের চিকিৎসায় আট লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে।
কীভাবে আক্রান্ত হলেন তারা : এক পরিবারের এতজন মানুষ কীভাবে আক্রান্ত হলেন জানতে চাইলে সেজো ছেলে বলেন, আমাদের বাড়িটা পরিষ্কার। উত্তরের মেয়র লোক পাঠিয়েছিলেন। তারা দেখে গেছেন। বলেছেন, এখানে ডেঙ্গু হওয়ার কোনো কারণই দেখি না।
কিন্তু অন্যের পাপের বোঝা আমরা বহন করছি। আশপাশে যারা আছে তারা সচেতন না। প্রধান সড়ক থেকে নেমে এলাকার প্রবেশ মুখেই প্রচুর নোংরা আবর্জনার স্তূপ। তাতে পানি জমে থাকে।
এসব ময়লা ফেলার অন্য কোনো জায়গাও নেই। ১০-১৫ দিন পরপর সিটি করপোরেশনের গাড়ি ময়লা নিয়ে যায়। কিন্তু গাড়ি দিয়ে ময়লা নিয়ে যাওয়ার সময় তিন ভাগের এক ভাগ ময়লা নিয়ে যায়, বাকি দুভাগ ময়লা পড়েই থাকে। এসব কারণেই এ এলাকায় ডেঙ্গু বেশি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এই এলাকায় অনেক ডেঙ্গু রোগী। এর আরেকটা কারণ হচ্ছে এলাকা বেশ ঘিঞ্জি, অনেক ঘনবসতি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব তো আছেই। লোকজনও অসচেতন। এ কারণেই আশপাশের থেকেই আমরা আক্রান্ত হয়েছি।
এখন ডেঙ্গু-পরবর্তী জটিলতা : ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার পর এখন ডেঙ্গু-পরবর্তী জটিলতা পোহাতে হচ্ছে আক্রান্ত অনেককে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডেঙ্গু সেরে যাওয়ার পরও অনেকের জটিলতা দেখা দিয়েছে।
অনেকেই দুর্বল, অনেকের কাশি আছে। বড় মেয়ের প্রচুর কাশি হচ্ছে। মা দুর্বল। কলেজে ভর্তির অপেক্ষায় থাকা সানজিদার শারীরিক অবস্থাও দুর্বল। বাচ্চাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।
সে কারণেই ওদের অসুবিধা কম হয়েছে। রোগ সেরে যাওয়ার পরও জটিলতা সারাতে এখন নতুন করে চিকিৎসা করতে হচ্ছে ওই পরিবারের সদস্যদের।
এই এলাকায় ডেঙ্গু রোগী বেশি : এই পরিবারের সবাই চিকিৎসা নিয়েছেন স্থানীয় আইচি হাসপাতালে। সেই হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রতিষ্ঠাতা ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, উত্তরায় ডেঙ্গু রোগী বেশি।
বিশেষ করে উত্তরখান ও দক্ষিণখানে প্রচুর রোগী। এই হাসপাতালে দৈনিক ১২৫-১৩০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি থাকে। এখন পর্যন্ত মাত্র একজন মারা গেছেন।
তার বয়স ৮২ বছর। তিনি ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ছিলেন। এ বছর এখন পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছে।
এই চিকিৎসক জানান, সম্প্রতি এখানকার রোগীরা বেশি জটিল হয়ে হাসপাতালে আসছে। অনেকেই বাসায় চিকিৎসা করতে গিয়ে প্লাটিলেট যখন একদম কমে যায় ২০-২৫ হাজারে নেমে আসে, তখন আসে। তাতে রোগীর জটিলতা বাড়ছে। তবে সেরেও উঠছে।
এই এলাকায় ডেঙ্গু রোগী বেশি বলে জানান এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, এখানে ঘনবসতি। রোগীরা জানিয়েছে, উত্তরখান ও দক্ষিণখানের ড্রেনগুলোতে প্রচুর মশা। ড্রেনগুলো খোলা। প্রচুর বাড়িতে কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে।
যার ফলে জলাবদ্ধতা বেশি। পানি জমে থাকে। সরকারিভাবে এসব পরিষ্কার করার কোনো উদ্যোগ নেই।