সম্প্রতি বিবিসির ‘সানডে’ অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল মার্ক আলেকজান্ডার মিলি বলেছেন, শীত শুরু হওয়ার আগে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক হারে পাল্টা হামলা চালানোর জন্য ইউক্রেনের হাতে ৩০ থেকে ৪৫ দিন সময় আছে। তিনি স্বীকার করেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলো পুনরুদ্ধারে এযাবৎ চালানো পাল্টা হামলায় প্রত্যাশার চেয়ে খুব কমই সফলতা এসেছে। তবে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। হাতে যে কদিন সময় আছে, তাতে পরিকল্পিত পাল্টা হামলার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মার্ক মিলি তাঁর দেওয়া আগের একটি বক্তব্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি যুদ্ধের একেবারে শুরুতে বলেছিলাম, এই যুদ্ধ ধীরগতিতে এগোবে, যুদ্ধে টিকে থাকা কঠিন হবে এবং অনেক দিন ধরে চলবে। শুধু তা-ই নয়, এই যুদ্ধে অনেক লোকবল ক্ষয় হবে। এখন ঠিক সেটিই হচ্ছে।’
উল্লেখ্য, রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে পরাজিত ও উচ্ছেদ করতে ৪ জুন থেকে ‘কাউন্টার অফেনসিভ’ অপারেশন শুরু করেছে। বিবিসির একই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষাপ্রধান স্যার টনি রাডাকিন বলেছেন অন্য কথা। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন এ যুদ্ধে জয়ের পথে রয়েছে। রাশিয়া বরং ইউক্রেনের কাছে পরাজিত হচ্ছে। রাডাকিনের কথা অনেকের কাছেই হয়তো অবাস্তব মনে হতে পারে। তবে রাডাকিন তাঁর এ বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেন, যুদ্ধে রাশিয়ার লক্ষ্য ছিল ইউক্রেন দখল করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা। তাদের সে লক্ষ্য পূরণ হয়নি। ভবিষ্যতেও তা পূরণের সম্ভাবনা নেই। অতএব এ কারণেই ইউক্রেন বিজয়ী হতে চলেছে।
অপর দিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বক্তব্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত। পুতিন বলেছেন, ইউক্রেন এখনো আশা করছে যে পশ্চিমাদের দেওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদ, সাঁজোয়া যান দিয়ে যে প্রতিরোধ যুদ্ধ তারা শুরু করেছে, তা রাশিয়ার বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম হবে। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হয়নি। পুতিন আরও বলেন, বাস্তব সত্য হলো, কাউন্টার অফেনসিভ কৌশল শুরুর পর থেকে গত তিন মাসে ইউক্রেনের প্রায় ৭১ হাজারের বেশি সেনাসদস্য ও কর্মকর্তা প্রাণ হারিয়েছেন। পুতিন চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনের পরিণতি সম্পর্কে আরও বলেন, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি সবকিছু হারিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার পরই শান্তি আলোচনায় ফিরবেন। পশ্চিমা সামরিক বিশেষজ্ঞরাও ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছেন না। তাঁরা মনে করেন, ইউক্রেনের রাশিয়ার আক্রমণ প্রতিরোধ করার মতো সামর্থ্য নেই। বাস্তবতা হলো, ইউক্রেনীয়দের কাছে আকাশপথে যুদ্ধ করার মতো শক্তি নেই। ইউক্রেন ন্যাটো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সাহায্যের ওপর নির্ভর করে এ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো ইউক্রেনকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য দিয়েছে। এত বিপুল সহায়তা দেওয়ার পরও রাশিয়া যে ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে, ইউক্রেন তার সামান্যই পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, দিনে দিনে এ যুদ্ধে ইউক্রেনের বিশাল জনবল ও সম্পদ ক্ষয় হচ্ছে।
দিন যতই গড়াচ্ছ ইউক্রেনের দখল করা অঞ্চলের ওপর রাশিয়া তাদের দখলদারি যেন আরও জোরদার করছে। রাশিয়া ইতিমধ্যে দখলে নেওয়া চারটি ভূখণ্ডে শক্ত ও কার্যকর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। অপরদিকে ইউক্রেনের যে সামরিক শক্তি, তা দিয়ে রাশিয়ার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ করে পুনরুদ্ধার করা খুব সহজ হবে না। সম্প্রতি রাশিয়ায় যে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে
গেল, এর মধ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বরের গণভোটের মাধ্যমে আত্তীকরণকৃত ইউক্রেনের দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরঝিয়া ও খেরসনেও
নির্বাচন হয়েছে। এই নির্বাচনের ফলাফল পুতিন সরকারের জন্য যে আরও একটি বিজয়, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাশিয়া প্রমাণ করতে চাইছে যে এই দখল করা চারটি অঞ্চল চিরদিনের জন্য রাশিয়ার ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবে। যদিও এই চারটি অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অংশ রুশ বাহিনী এখনো নিজেদের দখলে নিতে পারেনি। পশ্চিমা সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং ফলাফল রাশিয়ার কবজা থেকে ভূমি পুনরুদ্ধারে ইউক্রেন সরকার ও পশ্চিমা বিশ্ব যে লক্ষ্য স্থির করেছে, তা থেকে সরাতে পারবে না।
ইউক্রেন যুদ্ধ আরও দীর্ঘ করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা যে পরিকল্পনা নিয়েছে, তারই অংশ হিসেবে ইউক্রেনে ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ অস্ত্র পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
১০০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তার অংশ হিসেবে ইউক্রেনে অত্যাধুনিক এম-১ আব্রামস ট্যাংক পাঠিয়েছে। এই ট্যাংক ব্যবহারের জন্য ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ গোলা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পারমাণবিক অস্ত্র ও বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করতে ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধকরণের প্রক্রিয়ার সময় উপজাত হিসেবে এই ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়। এই ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ গোলাগুলো বেশ শক্তিশালী। বর্তমানে বিশ্বে প্রচলিত যে আধুনিক ট্যাংক আছে, সেগুলো সুরক্ষার জন্য বর্ম ব্যবহার করা হয়। এই গোলা সেই বর্ম ভেদ করতে সক্ষম। এই ইউরেনিয়াম অবশ্য পারমাণবিক বিক্রিয়া করতে পারে না। এগুলো প্রকৃতি থেকে পাওয়া ইউরেনিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় নয়। তবে এই ইউরেনিয়ামের ঘনত্ব বেশি। তাই ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম ট্যাংক, মর্টারের গোলা ও বন্দুকের অগ্রভাগে স্থাপন করে লক্ষ্যবস্তুতে নিক্ষেপ করা হয়। ফলে লক্ষ্যবস্তু ভেদ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এগুলো লক্ষ্যবস্তুর সংস্পর্শে এসে আগুন
ধরিয়ে দিতেও সক্ষম।
২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এই গোলা ব্যবহার করেছিল। ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামের অল্পবিস্তর যে তেজস্ক্রিয়া হয়, তার প্রভাবে মানুষের ত্বকে জ্বালাপোড়া ও কিডনির সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়াতে পারে। মনে করা হচ্ছে, ইরাকের নাসিরিয়াহ শহরে শিশুদের জন্মগত ত্রুটির সঙ্গে এই অস্ত্র ব্যবহারের সংযোগ থাকতে পারে। মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র যত সহজে ইরাকে এই বিতর্কিত গোলাবারুদ ব্যবহার করে পার পেয়ে গেছে, ইউক্রেনে তা হয়তো সম্ভব হবে না। ইউক্রেনকে ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ গোলা সরবরাহের পদক্ষেপকে নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়া। জাতিসংঘও এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া ইউক্রেনকে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়েছে নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্ককে। বর্তমানে ডেনমার্কের কাছে ৪৩টি এফ-১৬ রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৩০টি ব্যবহারযোগ্য, অন্যদিকে নেদারল্যান্ডসের ২৪টি অপারেশনাল এফ-১৬ রয়েছে। এ বছরের শেষ নাগাদ প্রথমে ৬টি এবং পরে আরও ১৩টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ইউক্রেনে পাঠাবে ডেনমার্ক; অর্থাৎ মোট ১৯টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করবে দেশটি।
পশ্চিমারা ইউক্রেনকে এই যুদ্ধবিমান দিলে যুদ্ধক্ষেত্রে দৃশ্যত কোনো পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হবে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এফ-১৬ সরবরাহের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছেন, ‘রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণের কোনো ফল নেই। এতে কেবল তাদের হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়ছে। এভাবে সহায়তার মাধ্যমে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে পশ্চিমারা। এফ-১৬ সরবরাহের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলো উত্তেজনা বাড়ানোর রাস্তা বেছে নিয়েছে। রাশিয়া বলেছে, কোনো দেশ যদি ইউক্রেনকে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দেয়, তাহলে তারা বিরাট ঝুঁকির মুখে পড়বে। তবে ইউক্রেনের আকাশে যদি এফ-১৬ জঙ্গিবিমান দেখা যায়, তাহলে সামরিক কায়দায় তা মোকাবিলা করবে রাশিয়া। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য আভাস দিয়েছে, ইউক্রেন যেসব যুদ্ধবিমান পাবে তা শুধু আত্মরক্ষামূলক কাজেই ব্যবহার করা যাবে এবং রাশিয়ার ভূখণ্ডের ভেতরে কোনো আক্রমণ চালানোর সক্ষমতা বা এ রকম কোনো সহায়তা—কোনোটাই যুক্তরাষ্ট্র দেবে না।
লেখার প্রথমেই এ যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছিলাম। যুদ্ধের এ পর্যায়ে জয়-পরাজয় নির্ধারণ করার সময়ও হয়নি। এই মুহূর্তে জয়-পরাজয়ের বিষয়টি থমকে গেলেও যুদ্ধ কিন্তু থেমে নেই। আগের তুলনায় যুদ্ধের তীব্রতা কম হলেও, প্রায় দেড় বছরে উভয় পক্ষের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণও কম নয়। যদিও এ যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়ার হিসাব-নিকাশ অন্য রকম ছিল। তারা মনে করেছিল, দিন যত গড়াবে, ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা মিত্রদের সমর্থন ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। একসময় হয়তো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। আর সেই সুযোগে রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর সর্বশক্তি প্রয়োগ করে দখল করে নেবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে এর উল্টোটা। ইউক্রেনের প্রতিরোধ যুদ্ধে পশ্চিমারা বেশ ভালোভাবেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যদিও এ যুদ্ধে ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার জন্য তেমন ধরনের সহযোগিতা করেনি। তবে ইউক্রেনের মাটি থেকে রাশিয়াকে বিতাড়িত করার জন্য যতটুকু সহযোগিতা প্রয়োজন, ততটুকু সহযোগিতা তারা করে যাচ্ছে। পশ্চিমারা মনে করছে, এই যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে হতাহতের ঘটনা অনেক বেশি। তারা মনে করে, রাশিয়া এখন পর্যন্ত একটা দিশাহীন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া মানে যুদ্ধ জয় করা নয়। এর আগে আফগানিস্তানে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে এক দশক ধরে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েও সফলতার মুখ দেখেনি; বরং সেই যুদ্ধে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক অবস্থার এমন চরম অবনতি হয়েছিল যে শেষ পর্যন্ত অখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। পশ্চিমারা এবারও হয়তো সেই স্ট্র্যাটেজি নিয়ে রাশিয়াকে একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে এবং রাশিয়া যেন একটি দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত হয়।