রাজশাহী-পাবনা রেল রুটে এক মাসে ২০ বারের বেশি পাথর নিক্ষেপ, আতঙ্কে যাত্রীরা


, আপডেট করা হয়েছে : 16-09-2023

রাজশাহী-পাবনা রেল রুটে এক মাসে ২০ বারের বেশি পাথর নিক্ষেপ, আতঙ্কে যাত্রীরা

পাবনার ঢালারচর থেকে রাজশাহীর মধ্যে চলাচলকারী ট্রেনে দুর্বৃত্তদের পাথর ছোড়ার ঘটনা বেড়েছে। গত মাসে ২০ বারের বেশি পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে ট্রেনে কর্তব্যরত অ্যাটেনডেন্টসহ সাত-আটজন যাত্রী আহত হয়েছেন। দুর্বৃত্তদের একের পর এক পাথর নিক্ষেপে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।


জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১৪ জুলাই প্রথম পাবনা থেকে রাজশাহী পর্যন্ত রুটে ট্রেনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ট্রেনটি চালু হওয়ার পর পাবনাবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। এরপর রেলপথটি পাবনার ঢালারচর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢালারচর এক্সপ্রেস ট্রেনসহ নতুন রেলপথের উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু দুর্বৃত্তদের ট্রেন লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়ার কারণে সেই স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে।


অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৯ সালে ট্রেনে হামলার ঘটনা চরমে উঠেছিল। ওই বছর পাবনা-রাজশাহী রুটে কয়েকশ পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছিল। এতে ট্রেনের যাত্রী, কর্তব্যরত টিটিই, গার্ড, অ্যাটেনডেন্ট, কর্মচারীসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছিলেন। এতে আহত হয়ে একজন মারাও গিয়েছিলেন। গুরুতর আহত শিশু জিসান (৪) ও জুঁথিকে (১৪) রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। পরে পাবনা জেলা প্রশাসন, বাস মালিক, রেলওয়ে পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তি ও এলাকাবাসীকে নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় সভা করায় এবং অভিযুক্ত কিছু ব্যক্তিকে আটক করায় হামলা বন্ধ হয়েছিল। চার বছর পর আবার ট্রেনে ঢিল ছোঁড়া বেড়ে গেছে।


জানা গেছে, এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সন্ধ্যার পর অন্ধকার হলে দুবলিয়া থেকে তাঁতীবন্ধ স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে এই পাথর ছোঁড়ার ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে গত ১২ সেপ্টেম্বর ট্রেনের দুইদিক থেকেই পাঁচটি বগি লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়া হয়।


গত ১২ সেপ্টেম্বরের ঘটনা বলতে গিয়ে ট্রেনের যাত্রী কলেজছাত্র মাসুদ রানা (২০) বলেন, দুবলিয়া স্টেশনে মিনিট দুয়েক দাঁড়ানোর পর সন্ধ্যা ৭টার দিকে ট্রেন ছাড়ে। সামনেই তাঁতীবন্ধ স্টেশন। চারদিকে তখন অন্ধকার। আমি ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বেশ জোরেই ট্রেন চলছিল। হঠাৎ বাম হাতের কনুইয়ের কাছে তীব্র আঘাত পাই। দেখি, হাতে প্রায় ২০০ গ্রাম ওজনের একটা পাথর আঘাত করেছে। এরপর বৃষ্টির মতো পাথর ট্রেনে আঘাত করতে থাকে। ট্রেনের যাত্রীরা আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকেন। জানালা বন্ধ করতে করতেও পাথরের আঘাত পান। পাথরের আঘাতে আমার হাত ব্যাপক ফুলে যায়। ভাগ্য ভালো যে পাথরটি মাথায় বা চোখে লাগেনি।


ট্রেনে কর্তব্যরত অ্যাটেনডেন্ট একরাম হোসেন জানান, সুজানগর, সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলা অংশে ট্রেন ঢোকার পরেই তাদের পাথরের ভয়ে থাকতে হয়। ১২ তারিখ তার গায়েও পাথর লেগেছে। এতে তিনি প্রচণ্ড ব্যথা পেলেও ভাগ্যের জোরে বড় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছেন।


পাবনা-রাজশাহী রুটে ট্রেনে চড়তে গিয়ে পাথরের ঢিলে আহত কয়েকজন তাদের দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা জানান। তাদের একজন দাশুড়িয়ার বেনুয়ারা বেগম। তিনি জানান, চলন্ত ট্রেনে তার চোখে নোংরা কাদা ছুঁড়ে মারায় তিনি গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তিনি এখনো বাম চোখে ঝাপসা দেখেন।


কর্মসূত্রে সাঁথিয়া উপজেলার বনগ্রামে ভাড়া বাসায় থাকেন জিয়াউর রহমান। তিনি জানান, ট্রেনে করে নিজ বাড়ি রাজশাহীতে যাচ্ছিলেন। এসময় ঢিল এসে লাগে তার পাশে বসা এক যাত্রীর মাথায়। এরপর থেকে তিনি স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে বাসে চলাচল করেন।


এছাড়া পাথরের আঘাতে মাথা ফেটে গুরুতর আহত হয়েছিলেন দাশুড়িয়ার সাঈদ হোসেন। জমেলা খাতুন নামে ট্রেনযাত্রীর চোখের কোণে পাথরের আঘাতে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। আজমল হোসেন নামে এক ট্রেনযাত্রীর মাথা পাথরের আঘাতে জখম হয়েছিল। ট্রেনে দায়িত্বরতদের কাছ থেকে উপরোক্তরা ছাড়াও অনেক আহতদের কথা জানা গেছে।


রেলের একাধিক সূত্র এবং ট্রেনযাত্রীরা জানান, ট্রেন চালুর পর পাবনা-রাজশাহীর মধ্যে চলাচলকারী লোকজন এখন বাসে না গিয়ে ট্রেনে চলাচল করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। এ কারণে পাবনা থেকে রাজশাহীতে চলাচলকারী বাসগুলোতে যাত্রী স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। পাবনা- রাজশাহী রুটে ট্রেন চালুর শুরুর দিকে এক শ্রেণির বাস মালিকরা ভাড়া করা লোক দিয়ে ট্রেনে পাথর ও কাদা নিক্ষেপ করিয়ে ট্রেন যাত্রীদের ট্রেন বিমুখ করানোর কূটকৌশল গ্রহণ করতেন। তবে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে দফায় দফায় সভা ও সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিলে তা বন্ধ ছিল অনেক দিন। কিন্তু সম্প্রতি ট্রেন লক্ষ্য করে পাথর ছোড়া আবার বেড়ে গেছে।


এ বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শাহ সুফী নূর মোহাম্মদ বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। পাথর যারা ছোড়ে তাদের চিহ্নিত করা ও শাস্তি দেওয়া কঠিন। এর আগে আমরা কয়েকবার পাথর ছোড়ার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে ধরেছিলাম। কিন্তু এদের প্রায় সবাই ছিল কিশোর। কম বয়সী হওয়ায় তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। সামাজিক সচেতনতা ছাড়া এটা বন্ধ করা সম্ভব নয়। এরপরও আমরা এসব দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।


  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার