মুখোমুখি আ.লীগের এমপি-দলীয় নেতা


, আপডেট করা হয়েছে : 18-09-2023

মুখোমুখি আ.লীগের এমপি-দলীয় নেতা

মনোনয়নপ্রাপ্তির প্রতিযোগিতাসহ স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে দেশের অধিকাংশ নির্বাচনি এলাকায় আওয়ামী লীগের এমপি ও দলীয় নেতারা মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন। ক্ষমতাসীনদের এই বিরোধ ছড়িয়ে পড়েছে ওয়ার্ড পর্যন্ত। জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই প্রকট হচ্ছে এই বিরোধ। এর জেরে প্রাণ হারাচ্ছেন নেতাকর্মীরা। গুরুতর আহতের ঘটনাও ঘটছে। একদিকে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের মিত্রদের সরকার পতনের একদফার আন্দোলন, অন্যদিকে নিজেদের মধ্যকার এই বিরোধ চিন্তায় ফেলেছে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডকে। ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নীতিনির্ধারক এবং বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।


আরও জানা যায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের পাশাপাশি পদ-পদবি, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, অর্থ-বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট এই দ্বন্দ্ব নিরসনে একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েছে দলের হাইকমান্ড। কিন্তু এখন পর্যন্ত আসেনি তেমন কোনো কার্যকর ফল। কারণ, দলটির কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দলীয় সংসদ-সদস্য ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের মদদ দিয়ে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখছেন।


আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, দলের মধ্যে কোন্দল থাকলে অবশ্যই নির্বাচনে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। যেহেতু নির্বাচন সামনে, তাই দ্রুতই এই কোন্দল নিরসন করা দরকার। মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে তৃণমূলের নেতা ও দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের যে বিরোধ রয়েছে, তা দলের কেন্দ্রীয় নেতারা নিরসনের চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক যুগান্তরকে বলেন, বড় সংগঠনে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থেকে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হতেই পারে। এ ধরনের সমস্যা সাংগঠনিকভাবে উদ্যোগ নিয়ে সমাধান করা হয়। এভাবেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অতীতে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থেকেছে, আগামী দিনেও দলের ঐক্য সুসংহত থাকবে।


আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। আর প্রতিযোগিতা থাকলে বিরোধ দেখা দিতে পারে। তবে নেতাকর্মীরা দলীয় স্বার্থে সব সময় ঐক্যবদ্ধ। এ কারণেই আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে বড় ও পুরোনো সংগঠন হিসাবে এখনো শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে।


জানা যায়, ১০ সেপ্টেম্বর চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সংবাদ সম্মেলনে স্থানীয় সংসদ-সদস্য আলী আজগার টগরের নেতৃত্বে হামলার ঘটনায় দলটির দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আজাদুল ইসলাম আজাদ, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান মঞ্জুসহ ১০ দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী একমঞ্চে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেন। এমপি আলী আজগার টগরের সমর্থকরা ওই সংবাদ সম্মেলনে হামলা চালান। এ সময় পালটাপালটি ধাওয়া ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর হয়। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।


কিশোরগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক ডিআইজি আবদুল কাহার আকন্দের গণসংযোগ ও সমাবেশ মঞ্চ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন সংসদ-সদস্য এবং সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদের সমর্থকরা। ১৪ জুলাই পাকুন্দিয়া উপজেলার পাটুয়াভাঙা ইউনিয়নের মাইজহাটি গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠের এ ঘটনার পর দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে।


ঢাকা-৭ আসনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এবং সংসদ-সদস্য হাজী সেলিমের দ্বন্দ্ব পুরোনো। এর সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ও হাজী সেলিমের ছেলে মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিমের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণা। এর জেরে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের উপস্থিতিতে লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে হট্টগোল হয়।


কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে ২৯ জুলাই ঢাকা-২ আসনের সংসদ-সদস্য ও আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম এবং কেরানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় এক যুবক নিহত হন।


কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্য ও তার প্রতিপক্ষরা পালটাপালটি সমাবেশ আয়োজনের মাধ্যমে শক্তির মহড়া প্রদর্শন করে জনজীবনে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এক পক্ষে আছেন কুষ্টিয়া-৪ আসনের সংসদ-সদস্য সেলিম আলতাফ জর্জ। অপরপক্ষে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সদর উদ্দীন খান, সাধারণ সম্পাদক আসগর আলী, সিনিয়র সহসভাপতি জাহিদ হোসেন জাফর প্রমুখ।


সম্প্রতি নাটোরে এক যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হাতের কবজি কেটে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম রমজান গ্রুপের লোকজন যুবলীগ নেতা মিঠুন আলীর ডান হাতের কবজি কেটে নেয়। এ ঘটনায় আরও ৫ জন আহত হন। কিছুদিন আগে রমজান গ্রুপের নেতা নান্নু শেখকে কুপিয়েছিল দলীয় এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুলের লোকজন। এ ঘটনার জেরে নান্নু শেখের লোকজন মিঠুনের হাত কেটে নেয় বলে দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীরা ধারণা করছেন।


নোয়াখালী-৪ আসনের (সদর) সংসদ-সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর সঙ্গেও জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে।


টাঙ্গাইল-২ আসনের সংসদ-সদস্য তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনিরের সঙ্গে দলীয় নেতা ইউনুস ইসলাম তালুকদার, রকিবুল হক ও মাসুদুল হকের বিরোধ রয়েছে। এ আসন থেকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইউনুস ও মাসুদুল হক দলীয় মনোনয়ন চাইবেন।


টাঙ্গাইল-৮ আসনের সংসদ-সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলামের সঙ্গে সখীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ অনেক নেতার বিরোধ এখন প্রকাশ্যে। সম্প্রতি সখীপুরে সমাবেশ করে এমপির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তৃতা করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।


দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ-সদস্য শিবলী সাদিকের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের জমি দখলের অভিযোগে কয়েকটি মানববন্ধন হয়েছে। এ আসনে অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা এমপির নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।


লালমনিরহাট-২ আসনে বর্তমান সংসদ-সদস্য ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ এবং তার ভাই মাহবুবুজ্জামানের দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্যে। সম্প্রতি মন্ত্রীর এপিএস-এর নেতৃত্বে এ আসনের একজন মনোনয়নপ্রত্যাশীর ওপর হামলার ঘটনা দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।


ময়মনসিংহ-১ আসনের হালুয়াঘাটে বর্তমান সংসদ-সদস্য জুয়েল আরেং এবং উপজেলা চেয়ারম্যান মাহমুদুল হকের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে।


মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগে বিভক্তি দীর্ঘদিনের। আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এবং দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মাদারীপুর-২ আসনের সংসদ-সদস্য শাজাহান খানের প্রকাশ্য বিরোধে এ এলাকার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বিভক্ত।


জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে খুলনা-৬ আসনের সংসদ-সদস্য আক্তারুজ্জামান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জিএম মহসীন রেজার বাগ্বিতণ্ডা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।


শোক দিবসের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে জামালপুরের ইসলামপুরে সংরক্ষিত আসনের সংসদ-সদস্য হোসনে আরা লাঞ্ছিত হওয়ার পর ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ-সদস্য (জামালপুর-২) ফরিদুল হক খান দুলালের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে লিখিত অভিযোগ করেন।


গাজীপুর-১ নির্বাচনি এলাকায় জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠান আলাদাভাবে পালন করেছেন সংরক্ষিত আসনের সংসদ-সদস্য রুমানা আলী টুসী ও তার ভাই জামিল হাসান দুর্জয়। রহমত আলীর মৃত্যুর পর তার এ দুই সন্তান এক মঞ্চে আসেন না।


ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের সংসদ-সদস্য এবাদুল করিম বুলবুল ও সাবেক সংসদ-সদস্য এবং নবীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফয়জুর রহমান বাদলের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। তারা আলাদাভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করেন।


চাঁদপুরের আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সদর আসনের সংসদ সদস্য ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির দ্বন্দ্ব পুরোনো। দীপু মনি উপস্থিত থাকলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেন না।


মে মাসে পটুয়াখালী-৩ আসনের সংসদ-সদস্য এসএম শাহজাদার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করে সংবাদ সম্মেলন করেন দশমিনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল মাহমুদ লিটন। একই দিন সংসদ-সদস্যের সমর্থকরাও ইকবাল মাহমুদের বিরুদ্ধে পালটা সংবাদ সম্মেলন করেন।


মার্চে জেলার (পটুয়াখালী-৪) আরেক সংসদ-সদস্য আ স ম ফিরোজ এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব হাওলাদারের গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় দলের সভাপতি শেখ হাসিনার সামনে এ ঘটনা তুলে ধরেন স্থানীয় নেতারা।


গত বছর ঢাকায় পার্লামেন্ট মেম্বারস ক্লাবে কুমিল্লা-৪ আসনের সংসদ-সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম আজাদের হাতাহাতি হয়।


সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ-সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের সঙ্গে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশের বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে।


বরিশাল-৪ আসনের সংসদ-সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের সঙ্গে স্থানীয় নেতাকর্মীদের প্রকাশ্য বিরোধ রয়েছে। এই বিরোধের জেরে পঙ্কজ দেবনাথকে আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের পদ থেকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়।


কুমিল্লা-১১ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্য, সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক এবং স্থানীয় নেতা মিজানুর রহমানের অনুসারীদের মধ্যে ৬ জুন চৌদ্দগ্রামে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে। এ ঘটনায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রায় আড়াই ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে।


এর বাইরে আরও অনেক এলাকায় দলীয় সংসদ-সদস্যদের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের তীব্র বিরোধ রয়েছে।



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার